এই যে সমীরণের মনুষ্যচরিত্র সম্পর্কে সুগভীর গবেষণালব্ধ জ্ঞান, আজ সেই জ্ঞানটাকেই হাতিয়ার করে এগোতে হবে। শ্রীরাধিকার অভিসারে যাওয়ার মতোই। পথ দুৰ্গম, ক্ষুরস্য ধারা, ফণী ফোঁস ফোঁস করছে, পিছলে পড়ে আলুর দম হওয়ার চান্স আছে। তবু রাধা যেমন রোজই কুঞ্জে পৌঁছে যেত, সেও পৌঁছে যাবে।
রিস্কটা নেওয়ার দরকার ছিল না। কিন্তু গতকাল জুলেখা বলেছে আজ রাত থেকে থাকতে পারবে না। তার হাজব্যান্ড বাঙ্গালোর থেকে ফিরে আসছে। এই নতুন খবরে যথেষ্ট বিচলিত হয়ে সমীরণ বলল, তুমি তো বিয়েই করোনি!
মৃদু হেসে জুলেখা বলল, ওরকম বলতে হয়।
কোনটা সত্যি বলো তো? আগে যেটা বলেছিলে, না এখন যেটা বলছ!
যে-কোনও একটা। বাট আই অ্যাম লিভিং।
এ খবরে মাথায় বজ্রাঘাত হল তার। সে পাপী। আর কে না জানে, পাপীদের জন্যই পৃথিবীতে যত ভয়-ভীতির আয়োজন। নেশা করলে সে নানা অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস দেখতে পায়। একা ফ্ল্যাটে তার পক্ষে থাকা অসম্ভব। ক্ষণিকাকে ফিরিয়ে না এনে আর উপায় নেই।
তবে হিউম্যান নেচার সম্পর্কে তার জ্ঞান গভীর বলেই তার দৃঢ় বিশ্বাস। সকালের দিকে ক্ষণিকার মেজাজ ভাল থাকে। এ সময়টায় সে হাসে, ঠাট্টা ইয়ারকি বুঝতে পারে, বেশ দয়ালু হয়ে ওঠে তার চোখের দৃষ্টি। ফুল অফ হিউম্যান কাইন্ডনেস। তার হৃদয়ের বালতি তখন উপচে পড়ে দয়া-দুগ্ধে।
তাই আজ সকালে অর্থাৎ বেলা সাড়ে আটটায়–সে অত্যন্ত মলিন মুখে এসে বসে আছে ক্ষণিকার বাপের বাড়ির বাইরের ঘরে। সে দাড়ি কামায়নি, পরিষ্কার জামাকাপড় পরেনি এবং মুখে হাসি নেই। ডোরবেল বাজানোর পর ঝি এসে দরজা খুলে বসিয়ে রেখে গেছে। ফঁকা ঘর। সোফাসেট, বুক কেস, কাশ্মীরি কাঠের পার্টিশন দিয়ে বেশ সাজানো ঘর। একটা বছর চারেকের বাচ্চা মেয়ে ঘরের কোণে বসে ডল নিয়ে খেলছে। খানিকক্ষণ তাকে লক্ষ করে হঠাৎ বলল, তুমি কে গো?
আমি! আমি একজন পাপী।
পাপী কী?
এ ম্যান ফুল অফ ভাইসেস। এ সিনফুল ম্যান।
তুমি আমার মায়ের বয়ফ্রেন্ড?
ওঃ, তা হলে এই মেয়েটিই ক্ষণিকার মেয়ে। ক্ষণিকা খুব তার মেয়ের গল্প করে। বাপের বাড়িতে তার নিঃসঙ্গ দিদির জিম্মায় থাকে। তাতে ক্ষণিকা মুক্ত থাকতে পারে। উড়ে উড়ে বেড়াতে পারে।
সে বলল, আমি একজন পাপী খুকি।
ঝি চা নিয়ে এল। ক্ষণিকা এল না। তবে চা আসাটা ভাল লক্ষণ। বরফ গলতে চাইছে। ইগোর চৌকাঠটা ডিঙোতে পারছে না। লজ্জার লতা যেন জড়িয়ে ধরছে অভিসারে গমনোদ্যোগী শ্রীরাধিকার দুখানি পা। একটু গলা খাঁকারি দিল সমীরণ।
বাচ্চা মেয়েটা হাম্পটি ডাম্পটি গানটা গাইছে। আজকাল কত বাচ্চাই গায়। সমীরণ চায়ে চুমুক দিল। এই সময়টায় ক্ষণিকার হৃদয়-বালতি ভরে আছে ফেনশীর্ষ দয়ার দুধে। এ সময়ে সে ভিখিরিকেও ফেরায় না। বাচ্চা মেয়েটার গানে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমীরণ একটু গুনগুন করল, ফেরাবে কি শূন্য হাতে?
ঘুমঘুম চোখে সামান্য একটু আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে শ্লথ পায়ে ভিতরের দরজায় এসে দাঁড়াল ক্ষণিকা। চোখে নিস্পৃহ দৃষ্টি। ঢিলা একটা ড্রাগনের ছবিওলা কিমোনো পরনে। চুলগুলো অবিন্যস্ত। চোখে অপার বিস্ময়।
এর সবটাই যে অভিনয় তা জানে সমীরণ। ওই চাহনি, ওই শ্লথ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিমা, ওই উপেক্ষার ভাব ওর আড়ালেই রয়েছে সেই অমোঘ বালতিটা। টলটল করছে ভরভরন্ত দুধে।
উদ্বেল হতে নেই। চায়ের কাপটা ধীরে নামিয়ে রেখে মাথা নত করে অপরাধীর মতো বসে রইল সে। এও অভিনয়। কমল হাসান বা নাসিরুদ্দিন শা-র সঙ্গে সে এখন পাঞ্জা কষতে পারে।
তুমি?
প্রশ্নটার জবাব দিল না সমীরণ। দিতে নেই। খুব ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়াল। মাথা
নিচু।
বাচ্চা মেয়েটা হঠাৎ বলে উঠল, ও লোকটা পাপী জানো মা?
ক্ষণিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, জানি। ওরকম বলতে নেই। ছিঃ।
বাঃ রে, ও-ই তো বলল।
বেশিক্ষণ ঘাড় নিচু করে থাকার ফলে সমীরণের ঘাড় টনটন করছিল। তবু থাকতে হচ্ছে।
ক্ষণিকা মুখোমুখি সোফায় এসে আলতোভাবে বসল। বলল, বোসো।
গলার স্বরটা নরম। সমীরণ খুব সাবধানে ধীরে ধীরে বসল।
জুলেখা চলে গেল বুঝি? রাখতে পারলে না?
সমীরণ একটু জিভ কেটে ফেলল। ভুলে। সামান্য খসখসে গলায় বলল, জানতে?
ওমা! জানব না কেন? তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রায়ই তো গিয়ে সব দেখে আসতাম। নবর মার সঙ্গে কথা হত।
সমীরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, পাপ কখনও গোপন থাকে না।
তা জানি না। তবে যাকে তাকে ডেকে আনছ, আজকাল কী ভীষণ এইডস হচ্ছে তা জানো?
পাপের বেতন মৃত্যু। জানি। কেন আমাকে একা ফেলে চলে আসো বলল তো। তুমি কি জানো না আমি একা থাকতে পারি না? বিশেষ করে তোমাকে ছাড়া? সেইজন্যই জুলেখাকে তাড়িয়ে দিয়েছি। হয় তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাব, নইলে বাবা পার্মানেন্টলি বাঙ্গালোর পাঠাতে চাইছে, সেখানেই চলে যাব।
জুলেখাকে তুমি মোটেই তাড়াওনি।
আলবত তাড়িয়েছি। চলো, দেখবে।
দেখার দরকার নেই। জুলেখাকে তাড়িয়েছি আমি।
তুমি?
হ্যাঁ। কাল আমি টেলিফোনে ওকে বিকেলবেলায় ধরেছিলাম।
ওঃ, তুমি মহীয়সী। তুমি কি জানো তোমার মতো—
থাক।
ক্ষণিকা, ক্ষমা—
আর হয় না সমীরণ। আর কিছুতেই—
আর কক্ষনও—
তোমার কথার কোনও দাম—
প্রমিজ। এই একবারটা–
না, প্লিজ। ফিরে যাও—
দয়া করো–
ওঃ সমীরণ—
তোমাকে ছাড়া—