হতে পারে।
আর যদি তা না হয়, যদি সত্যিই মিতালিদেবীরই লেখা হয় তা হলে বুঝতে হবে তিনি আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন।
মিঠু জবাব দিল না।
হাবুডুবুই যখন খাচ্ছিলেন তখন তার পক্ষে সবচেয়ে স্বাভাবিক হল, দেশে ফিরেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করা। তাই না?
নাও হতে পারে।
সেটা কীরকম?
অনেকে আছে, মনে মনে অনেক কিছু বানিয়ে নেয়, বাস্তবকে এড়িয়ে চলে।
মিতালি কি সাইকিয়াট্রিক কেস?
আমি জানি না।
আপনি এম সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের নাম কখনও শুনেছেন?
খুব সূক্ষ্মভাবে একটু শক্ত হয়ে গেল কিনা মিঠু, তা ভাল বুঝতে পারল না শবর। একবার চকিত দৃষ্টিনিক্ষেপ করে মাথা নিচু করল। বলল, কেন?
আহা, শুনেছেন কি না বলুন না।
শুনতেও পারি।
শুনেছেন মশাই, শুনেছেন। কলকাতার পুরনো অ্যাটর্নি। আপনার শ্বশুর এঁদের মক্কেল ছিলেন।
ও।
আপনি কি জানেন এঁদের কাছে মিতালিদেবীর একটা ডিড আছে?
থাকতে পারে।
অত নির্বিকার থাকবেন না। ডিডটা আপনার নামে করা। মিতালিদেবী তার সব সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের ভার আপনাকে দিয়ে গেছেন। আপনি এখন এক বিশাল সম্পত্তির মালিক। তাই না?
কাস্টোডিয়ান আর মালিক তো এক কথা নয়।
ডিডটা কি আপনি দেখেছেন? মিতালিদেবীর কলকাতার যাবতীয় সম্পত্তি দেখাশুনো, প্রয়োজনে বিক্রি করা বা যে-কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আপনাকে দেওয়া হয়েছে।
পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি একটা সাধারণ জিনিস।
খুব সাধারণ কি? তা ছাড়া মিতালিদেবীর সিঙ্গল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টকে সম্প্রতি জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট করা হয়েছে। আপনার সঙ্গে। এটাও স্বাভাবিক?
মিঠু একটা শ্বাস ফেলে বলল, কলকাতায় ওদের বিষয়সম্পত্তি দেখাশুনো করার কেউ নেই। ফলে–
ফলে উনি ওঁর ডিভোর্স করা স্বামীকে পরম বিশ্বাসে সব কিছুর ভার দিয়ে ফেললেন?
মিঠু চুপ।
মোটিভটা উনিই তৈরি করেছিলেন। মিতালিদেবীর সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছিল আপনাকে এতটা বিশ্বাস করা। সবকিছু যেই হাতের মুঠোয় এল অমনি নিষ্কণ্টক হওয়ার জন্য আপনি তাকে নির্মমভাবে সরিয়ে দিলেন!
কাজটা আমি করিনি।
নিজের হাতে করেননি বলছেন? তা হলে কি ভাড়াটে খুনি অ্যাপয়েন্ট করেছিলেন?
মিতালিকে খুন করার কোনও কারণ আমার ছিল না।
এগুলো কি কারণ নয়?
আমার কাছে নয়।
তা হলে আপনার সুবিধের জন্য আমি ঘটনাগুলো একটু সাজিয়ে দিই? শ্রীমতী মিতালি ঘোষ একদিন আমেরিকায় একটি ঘটনা থেকে আবিষ্কার করলেন যে, তিনি আপনাকে আকণ্ঠ ভালবাসেন। সেই হদ্দমুদ্দ ভালবাসায় এই রোমান্টিক ও একটু ইমপ্র্যাকটিক্যাল মহিলা ডায়েরিতে পাতার পর পাতা নিজের হৃদয়াবেগে ভরে ফেলতে লাগলেন। অথচ ইগো এবং লোকলজ্জায় আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারলেন না। দেশে ফিরে এসে বরুণ ঘোষ কিছুদিন পর মারা গেলেন। মিতালিদেবী সেই মৃত্যু উপলক্ষে দেশে ফিরলেন। তিনি তখন সম্পূর্ণ একা! এই অবস্থায় তিনি আকুল হয়ে লজ্জা সংকোচ ঝেড়ে ফেলে প্রথমেই ছুটে এলেন আপনার কাছে। হয়তো আত্মসমর্পণও করলেন। এই গ্যাপগুলো যদি আপনি ভরাট করতে পারতেন তা হলে আমাদের পক্ষে সুবিধে হত। যাকগে, যা বলছিলাম। উনি তো আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন, কিন্তু আপনি তো খাচ্ছিলেন না। আপনার বুকে দীর্ঘকালের একটি অপমান বিষধর সাপের মতো অপেক্ষা করছিল। আপনার জন্মমাস নভেম্বর, আপনি একজন স্কোর্পিও। স্কোর্পিওর জাতকদের প্রতিশোধস্পৃহা হয় সাংঘাতিক। তার ওপর আপনি লোভী, সম্পত্তির লোভেই না আপনি মিতালি ঘোষের অতীতের কলঙ্কের কথা এবং বিয়েতে তার অনিচ্ছা জেনেও তাকে বিয়ে করেন। হয়তো বিয়ের পর তার সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে তাকে তাড়িয়ে দিতেন। কিন্তু থ্যাঙ্ক গড, মিতালিদেবী সময় থাকতেই আপনাকে ডিভোর্স করে আমেরিকায় চলে যান। আপনার কপালটা কিন্তু দারুণ ভাল। মিতালিদেবী সম্মোহিতের মতো ফিরে এসে আপনার কাছেই নিজেকে সমর্পণ করলেন। এর চেয়ে সুবর্ণ সুযোগ আর কী হতে পারে বলুন! তার ওপর আপনি একজন গুন্ডা প্রকৃতির লোক। নিষ্ঠুর ও আবেগহীন। এ কুল কাস্টমার। আপনি মিতালির তালে তালে একটু নাচলেন। তার সম্পত্তির কাস্টোডিয়ান হলেন, জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের কয়েক লাখ টাকা আপনার নাগালের মধ্যে এসে গেল। এরপর মিতালিদেবীর মতো একজন আবেগসর্বস্ব, ছিটিয়াল মহিলাকে জিইয়ে রাখার কোনও কারণ আপনার ছিল না। তাই না? নিজেই হোক বা ভাড়াটে লোক দিয়েই তোক আপনি তাকে সরিয়ে দিলেন। বাই দি বাই, খুনের দিন রাতে একটা থেকে দুটোর মুধ্যে আপনি কোথায় ছিলেন বলুন তো!
০৪. একজন লোক সকালবেলায়
একজন লোক সকালবেলায় একরকম, দুপুরে অন্যরকম, বিকেলে একেবারে আরও অন্যরকম। ধরা যাক লোকটার নাম রমেন বা শ্যামলী। সকালের রমেন বা শ্যামলী বেশ নরম সরম, উদারচেতা, হাস্যমুখ। দুপুরের রমেন বা শ্যামলী নানা উদ্বেগ ও চাপে তিরিক্ষি, রগচটা, মারমুখী এবং কঞ্জুষ। বিকেলের রমেন বা শ্যামলী ক্লান্ত, উদ্দেশ্যহীন, হতাশ, পর্যদস্ত। এই যে একজনেরই নানা প্রকাশ বা স্ফুরণ এটা ধরতে পারাই হচ্ছে চূড়ান্ত বিচক্ষণতা। রমেন বা শ্যামলীর মধ্যেও তফাত আছে। রমেন হয়তো সকালে তিরিক্ষি বিকেলে নরম, শ্যামলী তার উলটো। একজন মানুষ নানা অবস্থা, নানা পরিস্থিতি, নানা চাপ, নানা উদ্বেগ ও ব্যস্ততায় অন্য অন্য সব মানুষ হয়ে যায়। সকালের রমেনকে দুপুরে দেখলে রমেন বলে মনেই হবে না। দুপুরের শ্যামলীকে যদি মনে হয় বনলতা সেন, রাতে তাকেই মনে হতে পারে বান্ধবগড় জঙ্গলের ভালুক বলে। জীবন তো এরকমই। রবীন্দ্রনাথ তো বলেই দিয়েছেন, তার জীবনটা হল নানা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গাঁথা একখানা মালা। হোয়াট অ্যান এক্সপ্রেশন! লা জবাব।