মিঠু মিত্রকে কি ভোলা হবে স্যার?
এখন নয়। তুমি বাড়িটা আর একবার সার্চ করো। দেখো, যদি সিগনিফিক্যান্ট কিছু পাও।
নন্দলাল চলে গেল। শবর চিন্তিত মুখে চেয়ার টেনে বসল। এইটেই মিতালির শোয়ার ঘর। দক্ষিণ পশ্চিম এবং পুব ভোলা। দেয়ালে হালকা ক্রিম রং। আসবাব সবই খুব উঁচু জাতের। বার্মা সেগুনের ডবল খাট, বড় ওয়ার্ডরোব, হাফ সেক্রেটারিয়েট এবং রিভলভিং চেয়ার, কাশ্মীরি কাজ করা ছোট টেবিল, ওয়াল ক্যাবিনেটে নানা দামি জিনিস সাজানো। হাতির দাঁতের মূর্তি, রুপোর ওপর মিনার কাজ করা রেকাবি, পুতুল, দুটো মজবুত স্টিলের আলমারি। সবই খুলে দেখা হয়েছে।
খাটের কাছ বরাবর মেঝেতে পড়ে ছিল মিতালি। মোট দু’বার তাকে ছুরি মারা হয়েছিল। পিঠের দিক থেকে, হৃৎপিণ্ড বরাবর। মিতালি পড়ে ছিল কাত হয়ে, বাঁ দিকে। চারদিকে অন্তত বারো-তেরোটা সেন্টের শিশি ভাঙা অবস্থায় ছড়িয়ে ছিল। ঘর সুগন্ধে এত ভরা ছিল যে পুলিশ কুকুর সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হয়ে যায়। স্নিফার ডগকে বিভ্রান্ত করার জন্যই যে সেন্টের শিশিগুলো ভাঙা হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। একজন কেয়ারটেকার, একজন রান্নার লোক এবং একটি কাজের মেয়ে কোনও নতুন কথা বলতে পারেনি। ককটেল ডিনারে ডিনার সার্ভ করেছিল এক নামী ক্যাটারার। তাদের কাছ থেকেও পাওয়া যায়নি তেমন কোনও সূত্র। মোটামুটি যা জানা গেছে তা হল, রাত এগারোটা নাগাদ মিতালি সামান্য মাতাল অবস্থায় ওপরে উঠে আসে। দোতলায় সে একা থাকত। সে শোয়ার ঘরে ঢুকে যাওয়ার পর মধ্য রাতে রান্নার লোক হরেন আর মালি ভজুয়া অনেক শিশি বোতল ভাঙার আওয়াজ পায়। মিতালি মাতাল অবস্থায় ওসব করছে ভেবে ওপরে ওঠেনি ভয়ে।
শবর উঠল। খানিকক্ষণ পায়চারি করল। তারপর পিছনের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। খুন করে পালিয়ে যাওয়ার পক্ষে এই বারান্দাটি প্রশস্ত। পিছনে একটু বাগান এবং ঝোঁপঝাড় আছে। বারান্দা থেকে অনায়াসে নীচের ঘরের জানালার ওপরকার রেন শেড-এ নামা যায়। সেখান থেকে লাফিয়ে পড়লেই হল।
না, শবর দাশগুপ্ত খুশি হচ্ছে না। মোটিভ অ্যাঙ্গেলটা পালটে যাচ্ছে। কোথাও একটা নট রয়ে যাচ্ছে। চোখ বুজে সে আবার নতুন করে পূর্বাপর ভাবতে লাগল।
.
নমস্কার মিত্তিরমশাই। আপনাকে আবার জ্বালাতে এলাম।
ক্লান্ত, বিধ্বস্ত চেহারার মিঠু দরজাটা ছেড়ে দিয়ে ভদ্র গলায় বলল, আসুন।
আপনি তো বেশ ভেঙে পড়েছেন দেখছি।
ও কিছু নয়। বসুন।
আমাদের আরও কিছু জানার আছে মিত্তিরমশাই। উই ওয়ান্ট ইয়োর হেল্প।
বলুন।
আপনি সেদিন মিতালিদেবীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আপনাদের মধ্যে কথাও হয়েছিল। আমি সেই কথাগুলো জানতে চাই।
প্রথম স্টেটমেন্টেই বলেছি।
জানি। তবু আর একবার বলুন।
মিঠু মাথা নেড়ে বলল, ওর বেশি আমার কিছুই বলার নেই।
মিতালিদেবীই কি আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন?
মিঠু ক্লান্ত চোখে চেয়ে বলল, একটা যোগাযোগ হয়েছিল।
কীরকম যোগাযোগ? আপনার তো টেলিফোন নেই। তা হলে?
আমার অফিসে টেলিফোন আছে।
ওঃ হ্যাঁ, ও কথাটা মনে ছিল না। তা হলে মিতালিদেবী আপনাকে অফিসেই টেলিফোন করেছিলেন?
আমি সে কথা বলিনি।
যোগাযোগটা কবে হয়েছিল?
ঠিক মনে নেই।
মারা যাওয়ার দিন কি?
না।
না? তার মানে আপনার মনে আছে। ব্যাপারটা আপনি চেপে যেতে চাইছেন কেন?
কিছু কথা না বলার অধিকার আমার আছে।
কিন্তু তাতে একটা মার্ডার কেস ক্ষতিগ্রস্ত হলে নয়।
আমি যে কথা বলতে চাইছি না তার সঙ্গে ওর খুনের সম্পর্ক নেই।
আপনি কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে মিতালিদেবীর বাড়িতে যান?
না। হঠাৎ গিয়েছিলাম।
কিন্তু একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আপনাদের মধ্যে হয়েছিল?
সেভাবে নয়।
মিতালিদেবী দেশে এসেছেন তার বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে। প্রায় এক মাস আগে। এর মধ্যে তার সঙ্গে আপনার মাত্র একবারই দেখা হয়েছিল কি?
হ্যাঁ।
ইউ আর নট এ গুড লায়ার। প্লিজ, সত্যি কথা বলুন। তাতে আমাদের তদন্তের সুবিধে হবে।
কিছু কথা আমি বলতে বাধ্য নই।
আপনি কি জানেন পৃথিবীতে যেখানে যত বিবাহিতা মহিলা খুন হন তাদের অধিকাংশের খুনের পিছনেই থাকেন তাদের হাজব্যান্ডরা। শতকরা নব্বইটা কেসেই।
জানি।
জানেন কি যে, এই কেসেও আপনি প্রাইম সাসপেক্ট?
অনুমান করছি। কিন্তু আমার কিছু করার নেই।
ইউ আর এ কুল কাস্টমার।
মিঠু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কিছু বলল না।
মিঠুবাবু, আপনার পাসপোর্টটা একটু দেখাতে পারেন?
পাসপোর্ট! আমার পাসপোর্ট নেই।
সে কী! পাসপোর্ট করেননি?
না। আমার দরকার পড়েনি।
এই জেরক্স কপিগুলোর হাতের লেখা চিনতে পারেন?
পারি। মিতালির লেখা।
মিতালির লেখা বলে চিনলেন কী করে?
বলতে পারব না। চিনি।
এ হাতের লেখা কোথায় দেখেছেন? চিঠি বা ডায়েরিতে?
মনে নেই।
তিনি আপনাকে চিঠি লিখতেন?
না।
আপনি ডায়েরির এই তিনটে কপি একটু পড়ে দেখুন।
মিঠু কপিগুলো হাতে নিল। পড়তে লাগল। তার মুখের দিকে ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ দুটি চোখ নিষ্পলক নিবদ্ধ রইল সারাক্ষণ। মিঠুর মুখে তেমন কোনও ভাবান্তর হল না। পড়া শেষ করে সে একটা শ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে বসে রইল।
মিঠুবাবু, আমি ক্রাইমের লোক, হৃদয়ের ব্যাপারটা ভাল বুঝি না। এ ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই অবাক ঠেকছে। আপনি কি ব্যাখ্যা করতে পারেন?
না।
আপনার কি মনে হয় এগুলো ফল এবং ফ্রড? কেউ মিতালির হাতের লেখা নকল করে আমাদের বিভ্রান্ত করতে চাইছে?