আমি অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বললাম, আমার তো কেউ নেই!
কী কথার কী উত্তর। শুনে সুসান আরও অবাক। বলল, আরে তোমার আবার কে থাকবে? আমারই বা কে আছে? উই ডোন্ট নিড এনিবডি।
সত্যিই তাই। এদের কেউ নেই। মা বাবা ভাই বোন কারও তোয়াক্কা করে না। একা থাকে, স্বয়ংসম্পূর্ণ। দরকার মতো বিছানায় বয়ফ্রেন্ড ডেকে নেয়। তারপর তাকে ভুলেও যায়। জলভাত। আর বিয়ে করতে হলে এত হিসেবনিকেশ করতে বসে যে, ওটা বিয়ে না বিজনেস কন্ট্রাক্ট তা বুঝতে কষ্ট হয়।
আমি এদের কাছে পাঠ নেওয়ার চেষ্টা করছি। পারছি না। কিছুতেই পারছি না। আমার কেবলই মনে পড়ে সেই তোমার অনেকক্ষণ ধরে চুমু খাওয়ার কথা। তখন ঘেন্না করেছিল। আজ আমার সমস্ত শরীর আর মন সেই চুমুটার কথা ভেবে সম্মোহিত হয়ে যায়। অন্য কোনও পুরুষ কাছে এলে কুঁকড়ে যাই, স্পর্শ তো বটেই, কাছাকাছি হওয়াটাও সহ্য করতে পারি না। এ আমার পাগলামি নম্বর তিন।
.
(তিন) আজ বাবা এল। এয়ারপোর্টে বাবাকে আনতে গিয়েছিলাম। দেখলাম অল্প কিছুদিনেই বাবা বড্ড বুড়িয়ে গেছে। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি চালিয়ে আসছি, টুকটাক কথা হচ্ছে। কী করলাম জানো? হঠাৎ বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, মিঠুবাবুর কী খবর?
বাবা অবাক হয়ে বলল, মিঠুবাবু কে?
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, মিঠু মিত্র।
কী হবে খবর দিয়ে?
এমনি।
আমার বুক কাঁপছিল। লজ্জা করছিল।
বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ক’দিন আগে দেখা হয়েছিল। ভাল আছে।
আমি আরও কিছু শুনতে চেয়েছিলাম। বাবা বলল না।
কিন্তু দু’দিন পর এক রাতে ডিনারের পর বাবা আমাকে ডেকে বলল, হারে, তুই সেদিন মিঠুর খবর জানতে চাইলি কেন?
এমনি।
তোর কি মিঠুর কথা মনে হয়?
আমার চোখে ফের জল এল’ বাবার কাছ থেকে পালিয়ে এলাম।
পাশ করে চাকরি পেয়ে হস্টেল ছেড়ে বাসা করেছি। ভাড়া অবশ্য। শিগগিরই একটা বাড়ি কিনব। একা থাব। চাকরি করব। আর এভাবেই জীবনটা কাটিয়ে দেব, প্রবাসে–আমার নিয়তি তো এই।
কয়েকদিন পর বাবাকে নিউ ইয়র্ক দেখাতে নিয়ে গেছি। কিন্তু বাবার তেমন বিস্ময় নেই। কী যেন ভাবছে। মেট্রোপলিটান মিউজিয়ামে রেস্টুরেন্টে চা খেতে খেতে বাবা হঠাৎ বলল, এসব দেশে একটা মেয়ের পক্ষে একা থাকা বিপজ্জনক।
কত মেয়েই তো আছে। এদেশে একা থাকাই রেওয়াজ।
সেটা কেমনতরো কথা! একা থাকার রেওয়াজ তাদের কাছে, যারা নিরুপায়।
আমিও তো তাই।
তুই কেন নিরুপায়?
এ কথার কি জবাব হয়? চুপ করে রইলাম।
.
(চার) বাবাকে আজ প্লেনে তুলে দিয়ে এলাম। প্রায় এক বছর আমার কাছে রইল বাবা। কী যে ভাল লাগত। আর কিছু নয়, বাড়ি ফিরে একজন আপন মানুষকে তো দেখতে পেতাম! এ দেশের একাকিত্ব তুমি ভাবতেও পারবে না। পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে মাখামাখি করা যায় না, আজ্ঞা নেই, হুটহাট কারও বাড়ি যাওয়া যায় না। চেনাজানা লোকদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে বলে আর কত সময় কাটে? সময়ও হাতে কম। উদয়াস্ত হাসপাতাল, রুগি, রিসার্চ।
গতকাল বাবা বলছিল, একটু ভেবে বল, দেশে কাউকে তোর কোনও মেসেজ দেওয়ার আছে?
মাথা নেড়ে বললাম, না বাবা।
মিঠু বোধহয় এখনও তোকে ফেলবে না।
আমি তো তার দয়া চাই না।
তোর যে কেউ নেই।
তুমি তো আছ।
আমি আর ক’দিন? আমার ইচ্ছে মিঠুর সঙ্গে বিয়েটা মেনে নে। সে বরং এখানে চলে আসুক।
থাক বাবা। সে নিশ্চয়ই আমাকে ঘেন্না করে।
রাগ তত থাকতেই পারে। কিন্তু সে বুদ্ধিমান, বিবেচক ছেলে।
থাক বাবা।
মুখে যাই বলি, বুকটা কেমন করছিল, এমন কি হয়? এমন কি হতে পারে? হলে হয়তো ভালও হবে না। কল্পনা এক, বাস্তব আর এক। মিলবে না হয়তো।
উজ্জ্বল অ্যাপ্রোচ করছে। বারবার। জানি, এটা সম্ভব নয়। তবু উজ্জ্বল যে আসছে তা মেনেও নিই। আর কিছু নয়। এই সাংঘাতিক একাকিত্ব থেকে তো খানিকটা মুক্তি। একজন কথা বলার লোক।
মোট বারোটা এয়ারোগ্রাম জমা হয়েছে। ওপরে তোমার নাম আর ঠিকানা। ভিতরে তিন বা চার লাইন লেখা। সবচেয়ে বড়টায় লিখতে পেরেছি তেরো লাইন। পছন্দ হচ্ছে না।
বাবা চলে যাওয়ার পর খুব কাঁদলাম। অনেকক্ষণ ধরে। আমার যে কী হবে।
.
তিনটে জেরক্স কপির দিকে চিন্তিত মুখে চেয়ে ছিল শবর দাশগুপ্ত। মিতালির ডায়েরিতে এই তিনটে পাতাই পাওয়া গেছে। বাদবাকি পৃষ্ঠা সাদা। লেখাগুলোর ওপরে বা নীচে কোনও তারিখ নেই। অনুমান করা যায় প্রথমটা আর শেষটার মধ্যে সময়ের তফাত দুই বা তিন বছরের। এর মধ্যে আরও অনেক পৃষ্ঠা লেখা হয়েছিল নিশ্চয়ই। সেগুলো কোথায় গেল বোঝা যাচ্ছে না।
কেসটা খুব মাখোমাখো হয়ে উঠছে স্যার। এ তো রীতিমতো লাভ অ্যাফেয়ার!
শবর তার বিচ্ছু টাইপের সহকারী নন্দলালের দিকে চেয়ে বলল, হাতের লেখা চেক করেছ?
হ্যাঁ। ওসব ঠিক আছে। মিতালিরই হাতের লেখা। শেষ টুকরোটায় উজ্জ্বল সেনের রেফারেন্সটা দেখেছেন স্যার?
দেখেছি। পান্টুর কী খবর?
বাড়ি নেই। ধানবাদ না কোথায় কোন ধান্দায় গেছে। আজ বা কাল ফিরবে। ফিরলেই তুলে নেব।
ক্ষণিকাদেবীকে চেক করো।
ও কে।
আর কোনও ডায়েরি খুঁজে পাওনি?
না স্যার। এই একটাই। মোট তিনটে এন্ট্রি। কোনও পাতা ছেঁড়া ছিল না।
কিন্তু বোঝা যাচ্ছে মিতালিদেবী সিস্টেমেটিক ছিলেন না। উনি এক-এক সময়ে এক একটা ডায়েরিতে লিখতেন৷ বাকি ডায়েরিগুলো হয় উনি আমেরিকা থেকে আনেননি, নয়তো চুরি গেছে।