জাহ্নবী লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে একটু হাসল। তারপর বলল, ছাই সুন্দর।
জানতে চাইছি, ওই দুটো সুন্দর চোখ দিয়ে তুমি ঠিক কী কী দেখেছ, যাতে মনে হতে পারে যে বিষাণ রায় নন্দিনী ম্যাডামকে পাত্তা দিতেন না।
ইদানীং দেখছিলাম নন্দিনী ম্যাডাম সকালের দিকে প্রায়ই দাদার ব্রেকফাস্টের সময় এসে উলটো দিকে বসতেন। বেশ সেজোগুজে।
সেজোগুজে?
মানে ঠিক খুব বেশি সাজ নয়। হয়তো একটা বেশ চটকদার কিমোনো পরলেন, চুলটা একটু কায়দা করলেন, অল্প মেক-আপ, হালকা লিপস্টিক। ওসব আপনি বুঝবেন না। মেয়েরা বুঝতে পারে।
তা তো ঠিকই। কিন্তু উনি হয়তো ওই সময়ে ব্রেকফাস্ট করতেই এসে বসতেন।
মোটেই না। ম্যাডাম বা নন্দিনী ম্যাডাম তো ব্রেকফাস্ট করেনই না। শশা, দই আর কয়েক টুকরো ফল।
তবে এসে বসতেন কেন?
বুঝে নিন।
দু’জনে কথাবার্তা হত না?
নন্দিনী ম্যাডাম বা দাদা কেউই খুব একটা বলিয়ে-কইয়ে মানুষ নয়। নন্দিনী ম্যাডামকে দেখেছি। টোস্টে বাটার লাগিয়ে দিতে। দরদ দেখানো আর কী। দাদা তো তাকিয়েও দেখত না।
তার মানে নন্দিনীর বিষাণের ওপর দুর্বলতা ছিল?
ছিল।
কখনও বাড়াবাড়ি কিছু দেখোনি?
বললাম তো দাদা পাত্তা দিত না।
ব্যাপারটা তোমার ম্যাডামকে জানিয়েছিলে?
বাপ রে। ম্যাডামকে কে বলতে যাবে?
তুমি কি জানতে যে তোমার ম্যাডামের একটা পিস্তল ছিল?
না। তবে ওই ঘটনার পর পুলিশের কাছে শুনেছি।
তুমি তো শিবাঙ্গীর ঘর গোছগাছ করতে, কখনও দেখোনি?
না। আমার তো ক্যাবিনেট বা লকার খোলার হুকুম নেই।
শিবাঙ্গী তো মাঝেমাঝে কলকাতার বাইরে যেত, তাই না?
হ্যাঁ। ওঁর ব্যাবসার কাজে যেতে হত। দিল্লি, বোম্বে, ব্যাঙ্গালোর, সিঙ্গাপুর, ব্যাঙ্কক।
ঘটনার আগে কবে শেষবার বাইরে গেছে বলতে পারো?
পারি। ম্যাডামের টুর আমায় মনে রাখতে হয়। মে মাসের ষোলো আর সতেরো তারিখে উনি বোম্বে গিয়েছিলেন। চকিবশ আর পঁচিশ তারিখে দিল্লি।
সেই সময়ে কি নন্দিনী আর বিষাণ এক ফ্ল্যাটে ছিল?
না। ম্যাডাম বাইরে গেলে আমাকে ফ্ল্যাটের ভিতরে থাকতে হত। ম্যাডামের ঘরে। অনেক দামি জিনিস আছে তো, তাই।
অর্থাৎ তোমাকে পাহারা দিতে হয়?
হ্যাঁ।
ম্যাডামের বিছানাতেই কি শোও?
বাপ রে। ম্যাডামের বিছানায় কে শোবে? ম্যাডাম কেটে ফেলবে তা হলে আমার একটা ফোল্ডিং খাট আছে, সেটা পেতে শুই।
তার মানে মে মাসের ষোলো, সতেরো, চব্বিশ আর পাঁচশ তুমি ম্যাডামের ঘরেই রাতে শুয়েছিলে?
হ্যাঁ। কিন্তু এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন? পুলিশ তো জিজ্ঞেস করেনি।
আমিও তো পুলিশ।
হুঁ। কিন্তু আপনি একটু অন্যরকম। ঠিক পুলিশ পুলিশ মনে হয় না। বাচ্চু বলছিল। আপনি নাকি সুপার কপ।
তা তো আমার জানা নেই। শুধু এটুকু জানি যে, আমি একজন পুলিশ কর্মচারী। তুমি বোধহয় জানো সেদিন রাতে শিবাঙ্গী নিজেকে বাঁচাতে তার পিস্তল থেকে এক রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল। গুলিটা খুনিদের একজনের গায়েও লাগে। ঘরের মেঝেতে তার রক্তের দাগ পাওয়া গেছে।
জানি। সব শুনেছি। ম্যাডামের হেভি সাহস।
আমি শুনেছি। তুমিও খুব সাহসী মেয়ে!
জাহ্নবী কাঁধটা একটু বাঁকিয়ে একটা বখাটে হাসি হাসল। তারপর বলল, এ বাজারে সাহসী না হলে আমাদের ক্লাসের মেয়েদের কি চলে?
মারপিট করো নাকি?
না, শুধু শুধুমারপিট করব কেন? তবে দরকার হলে হাত-পা চালিয়ে দিই।
এরকম কোনও ঘটনা কি ঘটেছে?
জাহ্নবী আবার হাসল, কেস দেবেন না তো স্যার?
আরে না। মেয়েরা মারপিট করলে আমি খুশিই হই।
তিন-চারবার মারপিট হয়েছে। বদমাশ ছেলেদের সঙ্গে।
বদমাশ ছেলেদের সঙ্গে! তুমি তো সাংঘাতিক মেয়ে। মেরেছি, না মার খেয়েছ?
মারপিট করলে মার খেতেও হয়। কোনও হিরো তো আর আমাদের বাঁচাতে আসে না, সিনেমার মতো।
ঠিক কথা। মেয়েরা হিরোর জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকবেই বা কেন? প্রত্যেকটা মেয়ের নিজেরই হিরো হয়ে ওঠা উচিত।
থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
করো।
দাদাকে কি আপনারা অ্যারেস্ট করবেন?
সেটা তদন্তের ওপর নির্ভর করছে। খুনিরা ধরা পড়ে গেলে এবং তোমার দাদার নাম বললে অ্যারেস্ট তো হবেই।
না। স্যার, দাদার নাম বলবে কেন?
বলবে না, তুমি কী করে জানো?
দাদা ও কাজ করতেই পারে না।
বাইরে থেকে দেখে মানুষকে আর কতটুকু চেনা যায়! তবে এখনই অ্যারেস্ট করা হচ্ছে না, এটুকু বলতে পারি। কিন্তু তোমার দাদার চেয়েও তোমার ম্যাডামের বিপদ বেশি। তাঁর হেড ইনজুরি, কোমায় আছেন। বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র ত্ৰিশ পারসেন্ট। তাঁর জন্য তোমার টেনশন হচ্ছে না?
হচ্ছে। খুব হচ্ছে। কিন্তু কাল ডাক্তার সেন দাদাকে বলেছেন, ম্যাডামের প্রাণের ভয় নেই। আমি নিজে শুনেছি।
তাই বুঝি?
হ্যা স্যার। কাল দাদাকে আমিই তো গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেছি।
তুমি কেন? বিষাণের তো আলাদা গাড়ি আছে।
আছে। কিন্তু ওঁর মনের যা অবস্থা গাড়ি চালাতে গেলে অ্যাক্সিডেন্ট করে বসবেন।
হুঁ। সে-কথা ঠিক। উনি খুব নার্ভাসনেসে ভুগছেন।
খেতে চাইছেন না, ঘুমোচ্ছেন না ভাল করে। ওজন কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। গালে বড় বড় দাড়ি। আমি গিয়ে হাতে-পায়ে ধরে খাওয়াই।
তুমি বললে খান?
খুব বিরক্ত হন। তবে সামান্য একটু মুখে তোলেন।
কতক্ষণ থাকো ওঁর কাছে রোজ?
কাছে থাকা তো সম্ভব নয়। উনি কম্পিউটারে কাজ করেন, কাগজ বা বই পড়েন, টেলিফোনে কথা বলেন। আজ তো পুলিশের পারমিশন নিয়ে অফিসেও যাবেন শুনেছি।