জাহ্নবী হেসে ফেলল। তারপর বলল, কী করব, দাদা যে বড্ড বেচারা মানুষ। দেখলেই মায়া হয়।
যদি প্রমাণ হয় যে বিষাণ রায়ই নন্দিনী আর শিবাঙ্গীকে খুন করার পিছনে রয়েছে?
মরে গেলেও বিশ্বাস করি না। আপনি তো দাদাকে চেনেন না। একদিন সকালে ব্রেকফাস্টের সময় একটা বড় নীল মাছি চলে এসেছিল টেবিলের ওপর। রাঁধুনি নিতাইদা সেটাকে একটা ফ্লাই স্নাটার দিয়ে মারে। দাদা তো প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল, কেন মারলি? কেন মারলি? বলে চোখ ছলছল। ভাল করে খেলই না সেদিন।
তুমি তো দেখছি বিষাণ রায়ের ডাই হার্ড ফ্যান!
হ্যাঁ তো। দাদাকে আমি ভীষণ ভালবাসি।
দাদাও কি তোমাকে ইকোয়ালি ভালবাসে?
দাদা। নাঃ, দাদা তো বাড়িতে কারও সঙ্গে কথাই বলে না। কারও দিকে তাকিয়েও দেখে না। খুব চুপচাপ থাকে। আমার তো মনে হয় রাস্তায়-ঘাটে আমাকে মুখোমুখি দেখলে দাদা চিনতেও পারবে না।
বিষাণ রায় কি এতটাই অন্যমনস্ক?
ভীষণ। কিন্তু গভীর মানুষ নয়। রাশভারী মানুষকে দেখলে যেমন ভয় ভয় করে, দাদাকে দেখলে তেমনটা হয় না।
তোমার সঙ্গে কখনও কথাটথা বলে না?
খুব কম। দাদা ফাইফরমাশ করতে পছন্দ করে না। তবে আমি মাঝে মাঝে গিয়ে ঘরটা একটু গুছিয়ে দিতাম।
ড্রাঙ্ক অবস্থায় বমি করলে তুমি কি কখনও ওঁকে অ্যাটেন্ড করেছ?
বমিটমি খুব একটা করে না তো! একবার বা দু’বার গিয়ে ধরেছিলাম। অনেকদিন আগে। আর একবার জ্বর হয়েছিল, তখন জোর করেই মাথা ধুইয়ে দিয়েছিলাম।
জোর করে কেন?
তখন ওঁর একশো চার ডিগ্রি জ্বর। বিছানা থেকে ওঠার শক্তি নেই। আমি মাথা ধোয়াতে চাইলে খুব আপত্তি করতে লাগলেন। কিন্তু আমি দেখলাম, মাথা না ধোয়ালে জ্বর হয়তো আরও বাড়বে। তাই নিতাইদাকে ডেকে এনে অয়েল ক্লথ বিছিয়ে একরকম জোর করে। অনেকক্ষণ ধরে মাথা ধুইয়ে দিয়েছিলাম। তাতে খুব খুশি ছিলেন। জ্বর ছাড়বার পর একদিন আমাকে ডেকে দুশো টাকা দিয়ে বললেন, শাড়িটাড়ি কিছু কিনে নিয়ো। আমি টাকা নিলাম না। বললাম, বাড়ির লোক সেবা করলে কি বখশিশ দিতে হয়? কথাটা ওঁর ভাল লেগেছিল।
বিষাণের সঙ্গে তোমার শেষ কবে দেখা হয়েছে?
রোজই তো হয়। কালও গিয়েছিলাম। আজও যাব। নার্সিংহোমে ম্যাডামকে দেখতেও যাই দু’বেলা।
তোমার তো ও বাড়িতেই থাকার কথা।
সেটা তো ভাল দেখাবে না। শত হলেও আমি তো বয়সের মেয়ে, দাদার সঙ্গে একা বাড়িতে থাকি কী করে? সকালে গিয়ে গাড়িটার স্টার্ট দিই। ডাস্টিং করি। দাদার ঘর, ম্যাডামের ঘরাও ডাস্টিং করতে হয়।
বিষাণবাবুর সঙ্গে মার্ডার নিয়ে কোনও কথা হয়েছে?
মার্ডার নিয়ে এত কথা হচ্ছে যে আর ওসব নিয়ে কথা কইতে ইচ্ছে করে না। দেখছি দাদা আজকাল ড্রিঙ্ক করছেন না, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও করছেন না। সারাদিন চুপচাপ বসে থাকেন, না হলে কম্পিউটারে কাজ করেন। দাড়ি বড় হয়ে গেছে। ওঁর খেয়াল রাখার তো কেউ নেই। আমার খুব কষ্ট হয়, কিন্তু কিছু বলতে সাহস হয় না। শুনছি পুলিশ নাকি ওঁকে অ্যারেস্ট করবে?
হ্যাঁ, তা পারে।
কিন্তু সেটা খুব ভুল হবে। দাদা ওরকম লোক নয়।
তা হলে খুনটা কে করেছে বলে তোমার মনে হয়?
আমি জানি না তো!
নন্দিনীর সঙ্গে বা তোমার ম্যাডামের সঙ্গে কারও শক্ৰতা ছিল জানো?
না। নন্দিনী ম্যাডাম তো সারাদিন কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আর কাজের লোকদের দিয়ে কাজ-করিয়ে নেওয়াটাও ওঁর কাজ ছিল। ফ্ল্যাটটা ছয় হাজার স্কোয়ার ফুটের। টুইন ফ্ল্যাট। অন্য ফ্ল্যাটটা তো ফাকাই পড়ে থাকে। তবু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হয়।
তোমার কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই?
বয়ফ্রেন্ড। নাঃ, আমার কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই।
কেন নেই?
কেন থাকবে? আজিকালিকার ছেলেগুলোকে দেখেছেন? সারাদিন ছোঁক ছোঁক করে মেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যখন একা গাড়ি চালাই প্ৰায় সময়েই কিছু পয়সাওলা ছেলেছোকরা গাড়ি করে পিছু নেয়। পাশাপাশি এসে জানালা দিয়ে খারাপ খারাপ কথা বলে। আপনিই বলুন, এদের কাউকে বয়ফ্রেন্ড বলে ভাবা যায়?
তুমি তো খুব চুজি দেখছি।
একটু আছি।
বলতে পারো নন্দিনী ম্যাডামের কোনও অ্যাফেয়ার ছিল কিনা।
ঠিক জানি না, উনি তো খুব আপনমনে থাকতেন।
ওঁর বয়স সাতাশ-আঠাশ, চেহারা ভাল। ওঁর তো কোনও বয়ফ্রেন্ড থাকারই কথা। কখনও কারও সঙ্গে ওঁকে দেখেছ?
না।
নন্দিনী ম্যান্ডামের সঙ্গে তোমার কেমন ভাব ছিল?
ছিল না স্যার। উনি আমাকে পছন্দ করতেন বলে আমার মনে হয় না।
কেন, তুমি কী করেছ?
কিছুই তো করিনি।
অপছন্দটা কীভাবে বুঝতে পারতে?
ওসব বোঝা যায়। আমাকে দেখলেই মুখটা আঁশটে হয়ে যেত।
ব্যস? ওটুকুই?
না। আরও অনেক ব্যাপার ছিল। ছোটখাটো ব্যাপার। তবে আমাকে ম্যাডাম তো বাইরের কাজেই বেশি পাঠাতেন, তাই আমাকে নন্দিনী ম্যাডামের মুখোমুখি বেশি হতে হত না।
তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। শুনে হয়তো তোমার ভাল লাগবে না।
কী কথা?
আমার সন্দেহ নন্দিনী ম্যাডামের সঙ্গে বিষাণ রায়ের একটা অ্যাফেয়ার চলছিল।
অসম্ভব!
অসম্ভব কেন? বিষাণবাবুর সঙ্গে শিবাঙ্গীর সম্পর্ক ভাল ছিল না। বিষাণবাবু একজন অ্যাট্রাকটিভ মানুষ এবং প্রচুর টাকার মালিক। নন্দিনী যথেষ্ট সুন্দরী, স্মার্ট, বুদ্ধিমতী। অ্যাফেয়ার তো হওয়াই স্বাভাবিক।
দাদা নন্দিনী ম্যাডামকে পাত্তাই দিত না।
কী করে বুঝলে?
বুঝব না কেন? আমার কি ড্যাবড্যাবে দুটো চোখ নেই?
আছেই তো! এবং চোখ দুটো খুব সুন্দর। কথাটা নিশ্চয়ই তোমাকে অনেকেই বলেছে।