তার মোটামুটি ভয়হীন জীবনে অনেকদিন বাদে হঠাৎ একটু যেন ভয়ের ব্যাপার ঘটল। খুন-জখম হয়ে যাওয়ার পর পুলিশের হুজতে হয়রান হয়েও ভয়টয় বিশেষ হয়নি তার। কিন্তু সোমবার সকালে জিনস-এর প্যান্ট আর সাদা হাওয়াই শার্ট পরা যে লোকটা তার সঙ্গে কথা বলতে এল তার চোখের দিকে এক পলক তাকিয়েই বুকটা ধড়ধড় করে উঠল। তার। অথচ লোকটা তেমন লম্বাচওড়া নয়। বরং একটু ছোটখাটো চেহারাই। পালোয়ানি শরীরও নয়। তবে গড়নটা মজবুত। কিন্তু চোখ দুটোই হাড় হিম করা। কাল রাতে মোবাইলে বড়বাবু তাকে ফোন করে বলে দিয়েছিলেন, সকালে সে যেন কোথাও না যায়, একজন গোয়েন্দা তাকে প্রশ্ন করতে আসবে।
যে এল তার নাম শবর দাশগুপ্ত। জিপ থেকে নেমে গলির রাস্তায় পা দিতেই বাচ্চু ছুটে এসে খবর দিল জাহ্নবীকে, কে এসেছে জানিস? শবর দাশগুপ্ত। সুপার কপ।
শবর দাশগুপ্তকে একটা চেয়ার দেওয়া হল। গোমরামুখো নয়। আবার বোকা বোকা হাসিও নেই মুখে। চারদিকে চেয়ে তাদের ঘরদোর একটু দেখল, তারপর তার দিকে চেয়ে বলল, এখানে কবে এসেছ?
ছয় তারিখে।
শিবাঙ্গীর বাড়িতে কতদিন আছ?
তেরো বছর বয়স থেকে।
তেরো বছর।
হ্যাঁ।
তেরো বছর বয়সের কাউকে কাজে রাখা বে-আইনি তা জানো?
বাঃ রে! আমি যখন আমার মায়ের কাছে থাকতাম তখনও তো ঘরের কাজ করতে হত। সাত-আট বছর বয়স থেকেই জল আনা, বাসন মাজা, ঘর ব্যাটানো, ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনা করা, সব। সেটা বে-আইনি নয়?
শবর এবার হাসল। ঝকঝকে সাদা দাঁত। তাকে আর একবার ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, শুনেছি। তুমি ষোলো বছর বয়স থেকেই গাড়ি চালাও।
হ্যাঁ। ম্যাডাম আমাকে সব কাজে পাকা করতে চেয়েছিলেন। আমি এক বছর যাবৎ গাড়ি চালাচ্ছি। কখনও কোনও অ্যাক্সিডেন্ট করিনি। কোনও কেস খাইনি।
হ্যাঁ। আমি তোমার রেকর্ড চেক করেছি।
আপনি কি আমার লাইসেন্স ক্যানসেল করে দেবেন?
না। ওটা মোটর ভেহিকলস ডিপার্টমেন্টের ব্যাপার। আর তুমি যখন গাড়ি ভালই চালাও তখন আমার গরজ কীসের?
থ্যাঙ্ক ইউ।
তুমি পুলিশের জেরায় বলেছ, ঘটনার সময়ে তুমি বাড়িতে ছিলে না।
না। পুলিশকে আমি তো বলেইছি যে সেই রাতে আমি ম্যাডামের বোন শ্যামাঙ্গীকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম বড় গাড়িটা নিয়ে। রাত বারোটায় সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ল্যান্ড করার কথা ছিল।
রাতের ফ্লাইটে রিসিভ করতে তোমাকে পাঠানো হয়েছিল কেন?
ওটা ইমার্জেন্সি ছিল। রঘুবীর সিং-এর মায়ের দয়া হয়েছিল সেদিনই। সকালে। তাই ম্যাডাম আমাকে পাঠান।
তুমি একা?
না। সঙ্গে বুম্বা ছিল।
বুম্বা মানে ইস্তিরিওয়ালা? নীচে যার গুমটি আছে?
হ্যাঁ। শ্যামাঙ্গী ম্যাডামের ফ্লাইট আধঘণ্টা লেট ছিল। রাত একটায় আমি ওঁকে পিক আপ করি। তারপর সোজা বারুইপুর। ফেরার সময় অবশ্য বুম্বা বাইপাসে সায়েন্স সিটির কাছে নেমে ফিরে আসে।
তুমি রাতে বারুইপুরে শ্যামাঙ্গীদের বাড়িতেই ছিলে?
হ্যাঁ। অত রাতে ওঁরা ফিরতে দিলেন না।
তুমি কখন খবর পাও?
খবর পাইনি। শ্যামাঙ্গী ম্যাডাম অনেকবার আমাদের ম্যাডামকে ফোন করেন। নন্দিনী ম্যাডামের নম্বরেও ফোন করা হয়। নো রিপ্লাই। আমরা ভাবলাম ম্যাডামরা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। শোওয়ার সময় ম্যাডাম ফোন সাইলেন্ট মোডে রেখে শুতেন। ওঁর ঘুমের প্রবলেম ছিল।
ওখান থেকে কখন ফিরে এসেছিলে?
সকালে ব্রেকফাস্টের পর। রাতেই আমি ম্যাডামকে একটি মেসেজ করে রেখেছিলাম যে, সকালে ফিরব। আমি সাড়ে আটটায় পৌছাই এসে। তখন পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। বাইরেও খুব ভিড়।
তুমি কি শিবাঙ্গীর সঙ্গে ফ্ল্যাটের মধ্যেই থাকো?
সবসময়ে নয়। সারভেন্টস কোয়াটারে আমার ঘর আছে। তবে অনেক সময়েই ম্যাডাম রেখে দিতেন।
নন্দিনী ম্যাডাম সম্পর্কে কিছু বলবে?
সব বলা হয়ে গেছে। তিন-চারবার করে। আর কী শুনবেন?
যা বলা হয়নি। ধরে যদি জিজ্ঞেস করি বিষাণ রায়ের সঙ্গে নন্দিনীর সম্পর্কটা কেমন ছিল। বা তুমি ওই দু’জনের মধ্যে কিছু লক্ষ করেছ কিনা।
না, কিছু ছিল না। দাদা ভীষণ ভাল লোক। ভীষণ ভাল।
বিষাণ রায়কে কি তুমি দাদা বলে ডাকো?
হ্যাঁ।
তা হলে শিবাঙ্গীকে বউদি নয় কেন?
উনি বউদি ডাক পছন্দ করেন না।
তুমি বিষাণ রায়কে পছন্দ করো?
কেন করব না? দাদা খুব ভাল।
বিষাণ মদ খায়, জানো তো!
ধুস। আজকাল কে না খাচ্ছে! ম্যাডাম খেতেন, নন্দিনী ম্যাডাম খেতেন, আমিও কতদিন খেয়েছিা।
বুঝলাম। বিষাণের কী কী গুণ আছে বলতে পারো?
আমি তো অতি জানি না। তবে দাদা কখনও মিথ্যে কথা বলে না, কখনও চোঁচামেচি করে না, কখনও কাউকে অপমান করে না, ম্যাডাম দাদাকে যা খুশি বললেও দাদা কখনও উলটে কিছু বলে না। মদ খাওয়া ছাড়া দাদার মধ্যে আমি কখনও কোনও বেচাল দেখিনি। আর ম্যাডাম ইচ্ছে করলেই দাদাকে মদ ছাড়াতে পারতেন।
কীরকম?
দাদা তো ম্যাডামকে ভীষণ ভয় পায়।
ভয় পায় কেন?
ম্যাডামের সব ভাল, কিন্তু বড্ড রিগচটা। খুব সামান্য কারণেই ভীষণ রেগে যান। দাদা ওই রাগকেই বোধহয় ভয় পায়।
শিবাজীর সঙ্গে নন্দিনীর কীরকম ভাব ছিল?
দু’জন তো বন্ধু। ভােব তো ভালই ছিল।
দু’জনের কখনও ঝগড়া হত না?
ম্যাডামের সঙ্গে ঝগড়া। পাগল নাকি? ম্যাডামের চোখে চোখ রেখে কেউই কথা বলতে পারত না।
তুমিও কি ম্যাডামকে ভয় পাও?
ও বাবা। সাংঘাতিক। তবে হ্যাঁ, ম্যাডাম আমাকে খুবই ভালবাসেন।
অথচ ম্যাডামের চেয়ে বিষাণ রায়ের প্রতিই তোমার পক্ষপাত বেশি। তাই না?