এই সাদা পোশাকের, সাদামাটা চেহারার লোকটা উঁচু গলায় কথা অবধি বলে না। ভারী মোলায়েম ভাষায় কথা কয়। গালাগাল দেয় না। ফালতু গরমও খায় না। একবার দুটো বাঘা চোখে দু’জনের দিকে চেয়ে নিয়ে চোখ নামিয়ে টেবিলের ওপর একটা পেপারওয়েট এক হাত থেকে অন্য হাতে এবং অন্য হাত থেকে ফের আগের হাতে গড়াতে গড়াতে বলল, টার্গেট একজন না দু’জন?
মাইরি স্যার, খুনখারাপি আমাদের লাইন নয়। ধরা পড়ার ভয়ে মেরে দিতে হল স্যার। শবর প্রশ্ন না করে অনেকক্ষণ দু’জনের দিকে চুপ করে চেয়ে বসে রইল। যেন গভীরভাবে কিছু ভাবছে। মিনিট দুয়েক পর একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, একটা প্রশ্নের জবাব না পেলে আমার অঙ্কটা মিলছে না। তোদের টার্গেট ক’জন ছিল, একজন না দু’জন?
দু’জনেই মুখ তাকাতাকি করে চুপ করে রইল অধোবদন হয়ে।
ভিক্টর! তুই বলবি? আমার যতদূর মনে হয় সেই রাতে তুই অপারেশনটা লিড করেছিল। বাদু নয়।
কাউকে মারার ইচ্ছে ছিল না। স্যার, বিশ্বাস করুন। গোলেমালে হয়ে গেল। আমাদের আপশোস হচ্ছে স্যার।
তুই যাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিস সে একজন মাইনর। যদি ধরা পড়ে তা হলে জুভেনাইল কোর্টে ট্রায়াল হবে। বড়জোর দু-তিন বছর কারেকশনাল হোমে সাজা কেটে বেরিয়ে আসবে। তাকে বাঁচানোর চেয়ে তোর নিজের গর্দান বাঁচানো অনেক ইম্পট্যান্ট।
ভিক্টর শুকনো মুখে বলে, আমাদের গর্দান তো যাবেই স্যার। আপনি কেস নিলে কি আমরা বাঁচব?
কেস নেওয়ার আমার কী দায়? চার্জশিট দেবে লোকাল পুলিশ। কেস স্ট্রং হলে ঘষে যাবি। আর যদি দাদাফাদা থাকে তো চার্জাশিটে জল ঢুকে যাবে। কোর্টে কত ক্রিমিনাল কেস ঝুলে আছে জানিস? শুনলাম, তোদের হয়ে একজন ঝানু উকিল মাঠে নেমেছে।
দু’জনেই একটু অধোবদন। তারপর ভিক্টর মুখ তুলে বলল, কথাটা কি কোর্টেও বলতে হবে?
জিজ্ঞেস করলে বলবি, তোর যদি ইচ্ছে হয়।
আমাদের টার্গেট একজন ছিল স্যার। নন্দিনী।
তা হলে শিবাঙ্গীর ঘরে ঢুকেছিলি কেন?
কাজটা তো গ্র্যাটিসের ছিল স্যার। আমরা কন্ডিশন করেই নিয়েছিলাম। ল্যান্ডলেডির ঘর থেকে কিছু মালু কামিয়ে নেব। কিন্তু ঘুমপাড়ানি রুমাল বের করারই সময় পাইনি, উনি গুলি চালিয়ে দিলেন। মরেও যেতে পারতাম স্যার!
তারপর?
বাদু ভয় পেয়ে পালটা ফায়ার করে। আমি বারণ না করলে আবার গুলি চালিয়ে দিত। কাজটা অন্যায় হয়েছে স্যার। ব্রিচ অফ ট্রাস্ট। শিবাঙ্গীকে আমাদের মারার কথা নয়।
শবর চিন্তিত মুখে বলে, আমার অঙ্কটা তবু মিলছে না।
কীসের অঙ্ক স্যার?
তোদের হয়ে যে উকিল মাঠে নেমেছে তার নাম জানিস?
না স্যার। একজন সেপাই বলছিল। আমাদের জামিনের জন্য নাকি একজন উকিল চেষ্টা করছে। কথাটা বিশ্বাস হয়নি। আমাদের মা-বাবারাও চায় যে, আমরা জেলে বন্ধ থাকি।
হুঁ। কিন্তু ওখানেই তো গণ্ডগোল। তোদের উকিলের নাম ব্ৰজবাসী দত্ত। কখনও নাম শুনেছিস?
দু’জনেই একসঙ্গে বলে, না স্যার।
কলকাতার টপ ক্রিমিনাল ল-ইয়ারদের মধ্যে একজন। অনেক টাকা ফি। টাকাটা কে দিয়েছে জানিস?
না স্যার।
আর ওখানেই অঙ্কটা মিলছে না।
শবর আবার কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। বলল, ঠিক আছে। আজ এই পৰ্যন্ত। দরকার হলে আবার আসব।
***
সকালে আজ অনেকদিন বাদে আয়নায় মুখ দেখল বিষাণ। নিজের দাড়িগোঁফওলা এই মুখটা তার চেনা নয়। যেন একটা অচেনা লোক তার সামনে।
অনভ্যস্ত দাড়িতে গাল কুটকুট করছে। একবার ভাবল কেটে ফেলবে কিনা। তারপর ভাবল, থাক। তার বেশ কিছু দাড়ি পেকে গেছে, এটা সে এতদিন টের পায়নি। তাকে বোধহয় এখন একটু বয়স্ক দেখাচ্ছে।
বয়স্কই। সে অনেকদিন জগিং করেনি। কোনওরকম ব্যায়াম করেনি। ফলে এখন তার শরীরের গাটে গাটে ব্যথা। বেশি পরিশ্রম করেত পারে না। সে যে একসময়ে দারুণ স্প্রিন্টার ছিল, এ তার নিজেরই বিশ্বাস হয় না। গত পঁচিশ দিন সে মদ খায়নি। অসম্ভব টেনশনে মদ ভাল কাজ করে। কিন্তু তার তেমন ইচ্ছে হয়নি। প্রথম চার-পাঁচদিন মদ পেটে না থাকায় ঘুম হচ্ছিল না। এখন হচ্ছে। খুব গাঢ় ঘুম নয়, তবু হচ্ছে তো।
আজ রবিবার। একা একটা ছুটির দিন কীভাবে কাটাবে সেটাই চিন্তার বিষয়। দিনটাও ভাল নয়। রাত থেকে একনাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। কে যেন বলছিল, নিম্নচাপ। তবে এটা বর্ষাকাল, বৃষ্টি তো হওয়ারই কথা।
লিভিং রুমে এসে খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে চেয়ারে বসতেই চমকে উঠল সে। মুখোমুখি আর একটা চেয়ারে একটা পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। শবর দাশগুপ্ত।
আরে আপনি! কখন এসেছেন?
মিনিট পাঁচেক।
খবর দেননি তো!
দরজায় নক করেছিলাম, আপনার কাজের লোকদের মধ্যে একজন দরজা খুলে দিয়েছে। আমার তাড়া নেই বলে আপনাকে খবর দিতে বারণ করেছিলাম।
বাঃ! আমার তো বোধহয় সময় হয়ে এল, তাই না?
কীসের সময়?
শুনেছি খুনিরা ধরা পড়েছে এবং তদন্তও শেষের মুখে। আমার স্ত্রীও নিশ্চয়ই তাঁর ভার্সান পুলিশকে বলেছেন!! আমি তো এখন দিন গুনছি।
কেন? খুনটা কি আপনি করিয়েছেন?
না। কিন্তু সে-কথা কে বিশ্বাস করবে বলুন?
পুলিশ যে আপনাকেই সাসপেক্ট ভাবছে তা কী করে বুঝলেন?
গাট ফিলিং।
আপনার ফিলিং নির্ভুল নয়।
আপনি কি কিছু বলতে এসেছেন শবরবাবু? সিরিয়াস কিছু? আপনাকে খুব গভীর দেখাচ্ছে!
আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। বিরক্ত হবেন না তো!
আরে না। আমার লুকোনোর কিছু নেই। আমি চাই তদন্তটা তাড়াতাড়ি শেষ হোক।