- বইয়ের নামঃ ঈগলের চোখ
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ পত্র ভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. বিষাণ
স্যার, আমি অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। ডিসিপ্লিন ব্যাপারটা আমার ধাতেই নেই। কিছুদিন দিব্যি রুটিন ফলো করতে পারি। সকালে ওঠা, দাঁত মাজা, দাড়ি কামানো, স্নান, বাটার টেস্ট আর ডিম দিয়ে ব্রেকফাস্ট, পোশাক পরে তৈরি হয়ে ব্রিফকেস নিয়ে বউকে একটা আলতো চুমু খেয়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়া–এসব মাসখানেক দিব্যি পারি। তারপরই আমার অস্থিরতা আসে। সাংঘাতিক অস্থিরতা। মনে হয়। এইসব রুটিন আমার গলা কেটে ফেলছে, হাত-পায়ে দড়ি পরাচ্ছে, একটা নিরেট দেয়ালে ঠেসে ধরছে আমাকে। আমার তখন ভীষণ কষ্ট হয়। পাগল পাগল। লাগে। আর তখনই আমি আমার কয়েকজন মার্কামারা পুরনো বন্ধুকে খবর পাঠাই। তারা ভাল লোক নয় ঠিকই, তবে বন্ধু হিসেবে খুব, খুব বিশ্বস্ত। খবর পেলেই তারা এসে হাজির হয়ে যায়। আর আমি তাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি। উধাও হয়ে যাই। কাঁহা কাঁহা মুল্লুক চলে যাই। বেশিরভাগই হয় আদিবাসী ভিলেজ, নয়তো কোনও খনি এলাকা, ডক অঞ্চল। অর্থাৎ যেখানে ভদ্রলোকরা থাকে না। চোলাই খাই, জুয়া খেলি, ভাড়াটে মেয়েদের সঙ্গে শুই। হয়তো এসব খুব খারাপ কাজ স্যার, কিন্তু ওইরকম বেপরোয়া বেহিসেবি পাগলাটে মর্যালিটিহীন কিছুটা সময় কাটালেই আমার অস্থিরতাটা চলে যায়।
তখন কি ফিরে আসেন?
হ্যাঁ স্যার। হয়তো এক সপ্তাহ কিংবা দিন দশ-পনেরো ওইরকম বাঁধনছাড়া জীবন কাটাতে না পারলে আমাকে সুইসাইড করতে হত।
আমাদের কাছে যা খবর আছে তাতে আপনার পাঁচজন বন্ধুর মধ্যে রাজু শেঠ আর নিমু। কর্মকার ডেঞ্জারাস ক্রিমিনাল। তা কি জানেন?
ওরা আমার আজকের বন্ধু নয় স্যার। ছেলেবেলা থেকে আমরা প্ৰায় একসঙ্গে বড় হয়েছি। ওদের সব জানি স্যার। রাজু খুব অ্যাগ্রেসিভ টাইপের। নিমু একটু চুপচাপ কিন্তু একরোখা। হ্যাঁ স্যার, আপনার ইনফর্মেশনে কোনও ভুল নেই।
প্রবাল, শতরূপ আর নন্দনও খুব ভাল লোক নয়।
স্যার, আমরা কেউ ভাল লোক বলে দাবি করছি না। আর ওই বন্ধুদের সঙ্গে বছরে দু’–তিনবারই আমার দেখা হয়। যখন আমরা উইকেন্ড অ্যাডভেঞ্চারে যাই। নইলে কে কী করে তা নিয়ে আর কেউ তেমন মাথা ঘামায় না।
আপনার এইসব অ্যাডভেঞ্চার আপনার স্ত্রী কী চোখে দেখতেন?
সে কি আর বলতে হবে স্যার? উনি আমাকে আপাদমস্তক ঘেন্না করতেন। যখন ফিরে আসতাম। তখন ওঁর চোখ যেন আমার সর্বাঙ্গে ছ্যাক দিত। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হত তখন।
রিকনসিলিয়েশন কীভাবে হত?
সময় লাগত স্যার। উনি আমাকে খুব অপমান করতেন, গালাগাল দিতেন।
ডিভোর্সের ভয় দেখাননি?
বহুবার। যতদূর জানি, ইদানীং ল-ইয়ারের সঙ্গে যোগাযোগও করেছিলেন।
বিয়ে কতদিনের?
সাত বছর।
প্ৰেম করে, না নেগোশিয়েটেড?
আপনি কি আমার ব্যাকগ্রাউন্ড জানেন স্যার?
জানি। তবু আপনি বলুন।
আমি প্ৰসাদ ফুড প্রোডাক্টের মালিকের ছেলে। সুতরাং আমাকে বড়লোকের ছেলে বলাই যায়। আমরা তিন ভাই, আমি মেজো এবং ফ্যামিলির ব্ল্যাক শিপ। আমার মিসঅ্যাডভেঞ্চারের জন্য আমি বাবার চক্ষুশূল। তিনি হয়তো আমাকে ত্যাজ্যপুত্ৰই করতেন। কিন্তু একটা কারণেই করেননি। তিন ভাইয়ের মধ্যে আমিই একমাত্র ফুড টেকনোলজি নিয়ে পড়েছি এবং পাশ করেছি। আমার আর দুই ভাই ম্যানেজমেন্ট পাশ করেছে এবং ব্যাবসাও বোঝে।। কিন্তু আমি প্রোডাকশনটা বুঝি। আপনি জানেন না যে আমি কিছু ইনোভেশন করার ফলে আমাদের প্রোডাক্টের কোয়ালিটি অনেক ভাল হয়েছে এবং বিদেশেও মার্কেট পাচ্ছে। শুধু এই কারণেই বাবা আমাকে তাড়িয়ে দেননি। যাতে আমি শুধরে যাই সেইজন্যই শিবাঙ্গীর মতো সুন্দরী মেয়ে খুঁজে আমার বিয়ে দেন। ইট ওয়াজ অ্যান অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ স্যার।
বুঝলাম। আপনার স্ত্রী যে সুন্দরী তা আমরা জানি। কিন্তু শিবাঙ্গীও আপনাকে শোধরাতে পারেনি, তাই তো?
হ্যাঁ স্যার।
বেলঘরিয়ায় আপনাদের বিশাল বাড়ি থাকতেও আপনি এই সাউথ ক্যালকাটায় ফ্ল্যাট কিনে বাস করছেন কেন? বিশেষ কারণ আছে কি?
আইডিয়া আমার বাবার। কেন তা বলতে পারব না। বাবা অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ। যা করেন ভেবেচিন্তেই করেন। আমার মা আপত্তি করেছিলেন বটে, কিন্তু বাবা বলেছিলেন, শিবাঙ্গীর সঙ্গে আলাদা থাকলেই নাকি আমার ভাল হবে। এই ফ্ল্যাট বাবাই কিনে দিয়েছেন।
কিন্তু এই ব্যবস্থায় আপনার ভাল হয়েছে কি?
না স্যার। আমি ইনকরিজিবল।।
স্ত্রীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কীরকম?
লুকওয়ার্ম। অলমোস্ট কোন্ড।
তার জন্য আপনি কাকে দায়ী করতে চান?
আমাকে। শিবাঙ্গী ভাল মেলে।
আপনার ওই মার্কামারা পাঁচজন বন্ধুকে কি আপনার স্ত্রী চেনেন?
ওরা আমার বাড়িতে বড় একটা আসে না। আমাদের বন্ধুত্বটা বাইরে। তবে শিবাঙ্গী ওদের দু-চারবার দেখেছে। বিয়ের সময়ে ওরা ইনভাইটেড ছিল। দু-তিনবার বিভিন্ন অকেশনে এসেছে। শিবাঙ্গী ওদের খুব ফর্ম্যালি চেনে। ঘনিষ্ঠভাবে নয়। সত্যি কথা বলতে কী, ওদের সঙ্গে আমারও বিশেষ যোগাযোগ থাকে না। যখন আমার ঘাড়ে অস্থিরতার ভূতটা চাপে তখনই ওদের ফোন করি, আর ওরা চলে আসে।
সবাই একসঙ্গেই চলে আসে?
না স্যার। তা কি হয়! সকলেই নানা ধান্ধায় ব্যস্ত। কখনও দু’জন বা তিনজন জুটে যায়। আজকাল পাঁচজন জোটে খুব কম।