মাঝে মাঝে এরকম আবোল তাবোল আঁকতে আঁকতে ছবিটা যেন হঠাৎ জীয়ন্ত হয়ে ওঠে এবং নিজেই নিজের সম্পূর্ণতার দিকে এগোয়। ছবিটা তখন আঁকিয়ের ওপর প্রভুত্ব করতে থাকে। আজ সর্বজিতের সেরকমই ভূতগ্রস্তের মতো অবস্থা। সে পাগলের মতো এঁকে যাচ্ছে। ডট-ড্যাশ, ডট-ড্যাশ…
ফোনটা এল বেলা বারোটা নাগাদ। চমকে যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল সর্বজিৎ। বিরক্তির সীমাপরিসীমা থাকে না এ সময়ে কেউ বিরক্ত করলে।
তবু উঠে ফোনটা ধরল সে।
আমি শবর বলছি। কী করছেন?
আঁকছিলাম।
বিকেল পাঁচটায় প্রেস কনফারেন্স, মনে আছে?
আছে। যাব।
জয় শেঠ আপনার জন্য গাড়ি পাঠাবে।
ওকে।
কী আঁকছেন?
আবোল তাবোল।
আঁকুন।
ফোন ছেড়ে দিল শবর।
দ্বিতীয় ফোনটা এল আধ ঘণ্টা বাদে। সর্বজিৎ কয়েকটা জায়গা একটু পরিবর্তন করছিল ছবিটার।
কে?
শুনলাম তুমি নাকি বিলুর বাবা নও?
সর্বজিৎ কিছুক্ষণ কে বিলু তা বুঝতেই পারল না, এমনকী নিজের স্ত্রীর কণ্ঠস্বরটাও নয়। একটু সময় লাগল বুঝতে। তারপর বলল, এসব কথা উঠছে কেন?
উঠছে তুমি বলে বেড়াচ্ছ বলেই।
বলে বেড়াচ্ছি না। তদন্তের জেরায় পুলিশকে বলেছি।
কী বলেছ? বিল্টু জারজ?
তা ছাড়া আর কী?
ইরার গলা হঠাৎ ফেটে পড়ল ফোনে, তোমার মুখ কেন খসে পড়ছে না বলো তো? কেন তুমি গলায় দড়ি দাও না? নিজের বউ মেয়েদের ন্যাংটো ছবি এঁকে বাজারে ছেড়েছ, নিজের ছেলের পিতৃত্ব অস্বীকার করে আমাকে চরিত্রহীন প্রমাণ করেছ, তোমার মতো নরকের কীট পৃথিবীতে আর আছে কি?
আমি মিথ্যে কথা বলিনি।
বলোনি? বলোনি? আজ থেকে দশ বছর আগে কী হয়েছিল তা তোমার মনে না থাকলেও আমার আছে।
কী মনে আছে?
সে কথা আজ উচ্চারণ করতে ঘেন্না করে। আই ওয়ান্ট ইউ ডেড।
সেটা আমি জানি।
হয় তুমি মরবে, নয়তো আমি। তুমি যে বাতাসে শ্বাস নাও সে বাতাসে শ্বাস নেওয়াও আমার পক্ষে পাপ বলে মনে হয়। বাস্টার্ড! ইউ বাস্টার্ড!
ওসব ছবি আমি আঁকিনি, কে এঁকেছে জানি না। সেই কথাটা পাবলিককে জানাতেই আমার কলকাতায় আসা।
সারাটা জীবন তোমার অনেক ন্যাকামি দেখেছি। তোমার মতো জঘন্য মিথ্যেবাদীও দুটি নেই। এখন নিজের চামড়া বাঁচাতে মিথ্যে কথা তো তুমি বলবেই। কিন্তু তাতে আমাদের আর কী লাভ? আমাদের যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়েই গেছে।
ক্ষতি হয়েছে স্বীকার করছি। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারো ক্ষতিটা আমি করিনি। আরও একটা কথা, এসব ছবি কি আমার গৌরব বাড়িয়েছে? বরং লোকে তো ছিঃ ছিঃ করছে।
তুমি নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করেছ। তোমার মতো নীচ মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব।
ঠিক আছে, তুমি যা খুশি কল্পনা করে নিতে পারো।
কল্পনা? তোমার মতো বেজন্মাই ওকথা বলতে পারে। যারা ছবি বোঝে, জানে, তারাই বলেছে এসব ছবি তোমারই আঁকা, এত পাপ আর বিকৃতি সর্বজিৎ সরকার ছাড়া আর কার চরিত্রে থাকবে?
ঠিক আছে। আর কিছু বলবে?
তোমার লেটেস্ট জঘন্য কাজ হল শবরের কাছে বিন্দুর পিতৃত্ব অস্বীকার করা। জিজ্ঞেস করি তোমার কি মানুষের চামড়া নেই শরীরে?
জিজ্ঞেস করাটা বাহুল্য, আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা কি তাতে পালটাবে?
না, পালটাবে না। কিন্তু বিন্দু বড় হচ্ছে। তার কানে যখন একথা যাবে যে, তুমি তার বাবা নও বলে প্রচার করছ তখন তার কী ধারণা হবে এবং সে কীভাবে সুস্থ জীবন যাপন করবে?
তা বলে যা সত্যি তা কি ঢেকে রাখতে পারি?
কোনটা সত্যি? তোমার পক্ষে কোনও গালাগালই যথেষ্ট নয়। কাজেই তোমাকে আর গালাগাল দিয়ে লাভ নেই। শুধু বলি, তোমার সত্যের চেহারাটা কীরকম তা কি তুমি নিজেও জানো না? দুনিয়াকে যা খুশি বোঝাও, কিন্তু তোমার নিজের কাছেও কি তুমি মিথ্যে? কীসের ওপর ভর দিয়ে বেঁচে আছ তুমি?
তুমি এখন উত্তেজিত, আমার কথা বুঝতে বা শুনতে চাইবে না। কিন্তু যদি শুনতে তা হলে আমারও কিছু বলার মতো কথা ছিল।
সে তো মিথ্যে কথা। ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা।
একটা মানুষ সব কথাই মিথ্যে বলতে পারে কি? দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মিথ্যেবাদীও পারে না।
ঠিক আছে, তোমার অজুহাত আমি শুনব, বলো।
মাথা ঠান্ডা করে শোনো। প্রথম কথা সুধাময়ের সঙ্গে তোমার কোনও রিলেশন আছে। কি না তা আমার জানা নেই। যদি তোমাকে কলঙ্কিতই করতে চাই তা হলেও তোমার সঙ্গে সুধাময়কে জড়াব এমন নির্বোধ আমি নই। কারণ, সুধাময় এখনও আমার খুব ভাল বন্ধু এবং সে আমার সাহায্যকারী। তোমাকে অস্বীকার করতে পারি, কিন্তু সুধাময়কে নয়। সুধাময়কে পাবলিকলি অপমান করলে আমি একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে হারাব।
সেটা জেনে বুঝেই তো তুমি কাদায় নেমেছ।
না, নামিনি। তোমাকে বে-আবরু করার ইচ্ছে থাকলে অন্য কারও সঙ্গে তোমাকে জড়াতে পারতাম। কিন্তু এসব আমার মাথায় আসেনি। এ কাজ আমার নয়, আরও প্রমাণ আছে।
কী প্রমাণ?
গত দু’ বছরের মধ্যে আমি একবারও রিখিয়ার বাইরে কোথাও যাইনি। তুমি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো, গত দু’ বছর আমি একবারও কলকাতায় আসিনি।
তাতে কী প্রমাণ হয়?
তাতে প্রমাণ নয়, অপ্রমাণ হয়।
তার মানে কী?
আমি বান্টু সিং বা ডেভিডকে চিনি না। তাদের কখনও দেখিনি। তাদের নামও জানতাম না। অচেনা, অজানা দুটো ছেলের রিয়ালিস্টিক পোট্রেট তো কল্পনা থেকে আঁকা যায় না।
তুমি মিথ্যে কথা বলছ। তুমি মেয়েদের পিছনে কাউকে লাগিয়েছ।
না ইরা, ইচ্ছে করলে তুমি শবরকে দিয়ে খোঁজ করাও। সে পুলিশের গোয়েন্দা। গত দু’বছর আমার গতিবিধি সম্পর্কে তদন্ত করে সে তোমাকে সঠিক তথ্য দেবে। আমার কিছুই লুকোনোর নেই।