আমি বিশ্বাস করছি না।
তুমি যে আমার কোনও কথাই বিশ্বাস করবে না তা জানি। বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করবেই বা কেন? রিখিয়ার স্থানীয় মানুষজন আমাকে রোজই দেখে। আমার কাজের লোক, দুধওয়ালা, প্রতিবেশী সকলেই সাক্ষী দেবে। গত দু’বছর আমি তোমাদের কোনও খবরই রাখিনি। কী করে জানব মেয়েরা কার সঙ্গে মিশছে?
ঠিক আছে, খবর নেব। কিন্তু তাতেও যে তোমার ষড়যন্ত্র ধরতে পারব তা মনে হয় না। তুমি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলে। তুমি সব করতে পারো।
তবু খবর নাও। ঘটনাটা কী তা বুঝতে সময় লাগবে। চট করে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেয়ো না।
ইরা ফোন ছাড়ল।
রিখিয়ার জলে গ্যাস বা অম্বল বিশেষ হয় না। কিন্তু কলকাতার জলে হয়। সকালের জিলিপি আর শিঙাড়ায় এখন বেশ অম্বল টের পাচ্ছে সর্বজিৎ। অস্বস্তি হচ্ছে। সে দুটো অ্যান্টাসিড খেয়ে নিল।
ছবিটা নিয়ে ফের বসল সে এবং টের পেল, ছবিটা শেষ করার তাগিদ আর ভিতরে নেই। সে নিবে গেছে। কিন্তু ছবিটা হচ্ছিল খুব ভাল।
সে ছবিটার সামনে চুপ করে বসে রইল খানিকক্ষণ।
আবার ফোন এল।
শুয়োরের বাচ্চা, খানকির বাচ্চা, তোর…
ফোনটা নামিয়ে রাখল সে। উত্তেজিত হল না। লাভ কী?
এসব গালাগাল তার জন্য প্রেস ক্লাবেও অপেক্ষা করছিল। বিকেল পাঁচটার কয়েক মিনিট আগে জয় শেঠের সঙ্গে সে যখন পৌঁছোল তখন ভিড়ে ভিড়াক্কার প্রেস ক্লাবের পিছনের হলঘরটায় ঢোকাই যাচ্ছিল না। ঠেলেঠুলে যখন শবর তাকে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে তখনই ভিড়ের ভিতর থেকে কে যেন গালাগালগুলো দিতে শুরু করল।
সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য একজন মারমুখো চেহারার কর্মকর্তা মাইক টেনে নিয়ে গর্জন করে উঠলেন, খবরদার! কোনও খারাপ কথা বললে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হবে। অ্যাই রথীন, দেখো তো কে কথাগুলো বলল। ধরে নিয়ে এসো।
সঙ্গে সঙ্গে সভাস্থল চুপ করে গেল। গালাগালকারীকে অবশ্য খুঁজে পাওয়া গেল না।
আজকের কনফারেন্সে মধ্যস্থ হিসেবে প্রবীণ শিল্পী মনুজেন্দ্র সেনকেও হাজির করা হয়েছে। সর্বজিতের পাশেই বসা। বললেন, কেমন আছ সর্বজিৎ?
ভাল থাকার কি কথা দাদা?
হ্যাঁ, কী যে সব হচ্ছে বুঝতে পারছি না।
আমিও পারছি না।
প্রেস কনফারেন্সের শুরুতে সেই মারমুখো কর্মকর্তা একটি নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিয়ে বললেন, সর্বজিৎ সরকারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে তিনি তার জবাব দিতে এসেছেন। মনে রাখবেন এটা প্রেস কনফারেন্স। কোনওরকম চেঁচামেচি বা গালাগাল বরদাস্ত করা হবে না। পরিবেশের গাম্ভীর্য ও মর্যাদা যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় আশাকরি আপনারা তার দিকে লক্ষ রাখবেন।
কর্মকর্তাটি কে তা বুঝতে পারল না সর্বজিৎ। তার সন্দেহ হল, লোকটি পুলিশের কেউ হতে পারে।
প্রথমেই সর্বজিৎকে কিছু বলতে বলা হল। তারপর প্রশ্ন। সর্বজিৎ শরীরটা ভাল বোধ করছে না। অম্বলটা তীব্রতর হয়েছে। মানসিক ভারসাম্যও যেন থাকছে না। অস্বাভাবিক একটা ঝিমঝিম ভাব মাথাটা দখল করে আছে।
সর্বজিৎ খুব শান্ত গলায় বলল, যে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে তার জন্য আমাকে দায়ী করা হচ্ছে। আমি কলকাতা থেকে অনেক দুরে থাকি। খবরটবর বিশেষ পাই না। অনেক দেরিতে আমি জানতে পেরেছি যে, আমার পরিবারকে হেয় এবং আমাকে অপদস্থ করার জন্য কেউ কতগুলো বিচ্ছিরি ছবি এঁকেছে এবং তা কলকাতায় দেখানোও হয়েছে। আমি সুস্পষ্টভাবে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে জানাতে চাই এগুলো কোনও অসৎ ও পাজি লোকের কাজ। ছবিগুলো আমার আঁকা নয়, আঁকার প্রশ্নই ওঠে না। আশাকরি পুলিশ এ বিষয়ে সঠিক তদন্ত করে কালপ্রিটকে খুঁজে বের করবে।
বিখ্যাত এক ইংরিজি দৈনিকের সাংবাদিক প্রশ্ন করল, আপনার আঁকা নয় সে তো বুঝলাম, কিন্তু দি পেইন্টার মাস্ট বি এ ক্লোজ পারসন অফ ইয়োর ফ্যামিলি। সো ইউ মাস্ট নো হিম।
না, আমি জানি না।
একজন তরুণ সাংবাদিক বলে উঠল, বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ ছবির স্টাইল অবিকল আপনার মতো।
তা হতেই পারে। লোকটা হয়তো ভাল নকলনবিশ।
আপনার কি নিজের ফ্যামিলির সঙ্গে ফিউড আছে?
না। থাকলেও সেটা পারিবারিক ব্যাপার।
আর একজন সাংবাদিক বলল, পারিবারিক ব্যাপারকে তা হলে পাবলিক করলেন কেন?
আপনারা কি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না? ছবিগুলো আমার আঁকা নয়। আমি গত দু’বছর কলকাতায় আসিনি।
তাতে কী প্রমাণ হয়?
ছবিতে যে দুটি ছেলের চেহারা আপনারা দেখছেন তাদের আমি কখনও দেখিনি।
ওটা বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি হল না।
পরে একজন বলল, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার ঝগড়া আছে বলে শোনা যাচ্ছে। ঝগড়াটা পুরননা। আপনার স্ত্রীর ধারণা আপনি তাকে পাবলিকলি অপমান করার জন্যই ছবিগুলো এঁকেছেন।
না। আমি এত নীচ নই।
এবার হঠাৎ কর্মকর্তাদের একজন বলে উঠল, নববাবু, আপনি কিছু বলবেন?
নব দাস উঠে দাঁড়াল। সেই নব দাস, যাকে একবার রেগে গিয়ে মেরেছিল সর্বজিৎ। নবর চুলে একটু পাক ধরেছে, শরীরে জমেছে একটু চর্বি। আর সব ঠিকই আছে।
নব দাস অনুত্তেজিত গলায় বলল, সর্বজিৎ সরকার বলছেন যে, ছবিগুলো ওঁর আঁকা নয়। এটা প্রমাণ করার খুব সহজ উপায় আছে। পুলিশের ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টরা যদি সাহায্য করে তবে সমস্যার সহজ সমাধান হতে পারে। আর্টিস্টকে তার পেইন্টিং হ্যান্ডেল করতেই হয়। আমার ধারণা অয়েলে আঁকা ছবির জমিতে কোনও না কোনওভাবে আর্টিস্টের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যাবেই। ওইসব জঘন্য ছবিতে সর্বজিৎ সরকারের ফিঙ্গারপ্রিন্ট খুঁজে দেখা হোক।