সেই চোর এই কথা বলে লোকটার সামনে তার পোঁটলা, খুলে দেয়, বলে তোমরা জন্য এনেছি ভাল তামাক, হুঁকো, একজোড়া শহরে চটিজুতো, ফলমূল–
এইভাবে মানুষেরা আসে। নিজেদের গল্প বলে। তাদের সংগৃহীত উপহার দিয়ে যায়। তারা জানে, এ লোকটা বেঁচে থাকলে তারা বাঁচবে, আঁচবে আরো হাজারটা লোক। তাই লোকেরা এসে তাকে ঘিরে বসে, নিজের খাবারের ভাগ দিয়ে যায়, দেয় পরিধেয়, কখনো বা শৌখীন জিনিস, রাত জেগে পাহারা দেয়।
তবু কেউই তাকে সঠিক বুঝতে পারে না। বলে–আরে! আহাম্মকটাকে দেখছি বিগ্রহ বানিয়েছে সবাই। প্রণামীর ঠেলায় আহাম্মকটা যে হয়ে গেল ধনী। কেউ বলে ঘড়েল লোকটাকে দেখ, আহাম্মকদের মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে!
এরকম বিবিধ কথা হয় লোকটার সম্বন্ধে। কিন্তু সকলেরই জিজ্ঞাসাবাপু, তুমি আসলে কে? আসলে কী? তুমি সত্যিকারে কেমন?
লোকটা উত্তর দিতে পারে না। আলো যেমন বলতে পারে না–আমি আলো, বাতাস যেমন বলতে পারে না–আমি বাতাস; সেইরকম সেও বলতে পারে না সে কী বা কে। কিন্তু মানুষের প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে পড়ে সে নিজেকে একরকম অনুভব করে। বুঝতে পারে যোজন যোজন বিস্তৃত তার অস্তিত্ব।সে কেবল পৃথিবীকে ভালবেসে গলে যায়। গলে যায় মানুষের দুঃখ দেখে।
চৈতন্যময় আলোর আণবিক কণিকাগুলি তাকে ঘিরে খেলা করে। তার ভিতর থেকে স্পন্দমান সৃষ্টির মূল শব্দটি উঠে আসতে থাকে। লোকটা ময়ুরপুচ্ছের মতো নীল আকাশের দিকে চায়, চেয়ে থাকে দূরের পাহাড়টির দিকে। হঠাৎ অনুভব করে, তারই অস্তিত্ব থেকে জন্ম নিচ্ছে আকাশ, বাতাস, নক্ষত্রপুঞ্জ, আলো এবং অন্ধকার। ঐ যে দূরের পাহাড়টি, রুপালি নদীটি, ঐ যে অবারিত মাঠ, অচেনা যেসব মানুষ চলেছে রাস্তা দিয়ে, এই যেসব গাছপালা, পশুপাখিএই সবই জন্ম নিচ্ছে তার অস্তিত্ব থেকে, ল্য পাচ্ছে তারই ভিতরে। সে তার এই অনন্ত অস্তিত্বের কথা লোককে বলতে পারে না। সে রাত জেগে দাওয়ায় বসে গুড়গুড় করে তামাক খায়, আর ভাবে, আর অনুভব করে। অনাবিল এক আনন্দের স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। সে সেই আনন্দের ভাগ কাউকেই দিতে পারে না। সে ঘোরেফেরে তার গাছপালাগুলির কাছে, বলে বেঁচে থাকে। বেড়ে ওঠো। সে পশুপাখি, গৃহপালিতদেরও বলে–বেঁচে থাকে। বেড়ো ওঠো। সে তার ছোট ছেলেটির মাথায় হাত রেখে বলে–বেঁচে থাকো। বেড়ে ওঠো। তার দেহ থেকে সৌরভ এবং আলোর মতো ঐ কথা সমন্ত বিশ্বচরাচরে ছড়িয়ে যায়–বেঁচে থাকো। বেড়ে ওঠে।
তারপর একদিন পড়ে থাকে তার সংসার, তার সঞ্চিত সম্পদ। সে এল একা চলে আসে পাহাড়ে। একটা গুহা খুঁজে বের করে। গুহায় ঢুকে সে গুহার মুখ বন্ধ করে দেয় ভারী পাথরে। তারপর সেই নিস্তব্ধতায় বসে নে মানুষের জন্য কয়েকটি সৎ চিন্তা করে মরে যায়।
লোকটা মরে যায়, তার সেই চিলি কিন্তু মরে না। তারা ধীরে ধীরে তার দেহ ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ঘুরে ঘুরে গুহা থেকে বেরোবার মুখ খোঁজে। তারপর তারা পাহাড় ভেদ করে, পার হয় নদী, প্রান্তর, পার হয়ে যায় সমুদ্র। অদৃশ্য কয়েকটি অলীক পাখির মতো মানুষের কাছে চলে আসে। ঘুরে ঘুরে বলে-তমসার পাড়ে আছেন এক আলোকময় অনামী পুরুষ। আমরা তার কাছ থেকে এসেছি, তোমরা আমাদের গ্রহণ কর।
কিন্তু, নিজের সুখ-দুঃখে কাতর মানুষ সেই ডাক শুনতেই পায় না।