বুড়োসুড়ো মানুষটা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। তারপর মাথা নেড়ে নিঃশব্দে জানায়। অনেকক্ষণ চিন্বিত মুখে তামাক খায়। তারপর একসময়ে লোকটার দিকে চেয়ে বলে–আমি ওসব কিছুই দেখিনি বাবা, কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি দেখলেও বা দেখতে পারো। হয়তো সত্যিই আছে ওসব। আমিও শুনেছি সৃষ্টির মূলে আছে এক শব্দ।
লোকটার আর চাষবাস করতে ইচ্ছে করে না, যেমন ইচ্ছে করে না গরুর দুধ দোয়াতে, ইচ্ছে করে না নিজের জন্য উপার্জন করতে। তা বলে সে বসেও থাকে না। সে লোয়াজিনা সংগ্রহ করে মানুষের জন্য। সে দেখে মানুষের জ্যোতি। বৈশিষ্ট্যমাফিক তাদের সমস্যার সমাধান করতে চেষ্ট করে। সে মানুষকে আকর্ষণ করে নিজের দিকে। দান করে দক্ষতা এবং ধর্ম। সে বা জনে সবই শেখায় তাদের, বর্ণভেদ অনুসারে। কেউ নেয় তার চিকিৎসাবিদ্যা, কেউ নেয় অঙ্কশাস্ত্র, কেউ শেখে চাষবাস।
বউ গঞ্জনা দেয়–তোমার সংসার যে ভেসে গেল।
লোকটা হাসে-তাই কখনো যায়!
বউ বলে–তোমার যে বৃত্তি-পেশা নেই, উপার্জন নেই!
লোকটা বলে–তা কেন! আমার সব আছে। যেখানেই আমি বীজ বপন করেছি সেখানেই দেখেছি বৃক্ষের উৎপত্তি! একথা ঠিক যে নিজের জন্য আমার কিছু করতে ইচ্ছে হয় না। কিন্তু মানুষে যদি বুঝতে পারে যে, আমাকে বাঁচিয়ে রাখা তাদের স্বার্থের পক্ষেই প্রয়োজন, তবে তারাই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। আমার লোয়াজিনা তারাই এনে দেবে আনাকে। সংসারের নরকোচটা এরকমই হওয়া উচিত। টান-ভালবাসার ওপর সংসার চলুক। আমি কোন স্বার্থ খুঁজে বেড়াব লোকের ভালবাসা জাগিয়ে দিই, তারা আমার সংসার কাকে করে নিয়ে যাবে। এই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ বৃত্তি।
কিন্তু বউ তা মানতে চায় না। ঝগড়া করে। ছেলেরা বড় হয়েছে, তারা বাপকে সাবধান হতে বলে। কিন্তু ততদিনে লোকটা হয়ে গেছে মানুষ-মাতাল জগতমাতাল। তার নিকটজনেরা তাকে বলে–অপদার্থ, বাউণ্ডুলে। তারা মনে করে এই লোকটাই তাদের দুঃখের কারণ। তারা লোকটার হাজার দোঝ দেখতে পায়, দেখে কাণ্ডজ্ঞানহীনতা।
কিন্তু যারা দূর থেকে আসে, তারা তার কাছে এসে এক আশ্চর্য সুগন্ধ পায়। তারা টের পায়, এক স্নিগ্ধ আলোর ছটা তাকে ঘিরে আছে। বলে—-আহা গো কী সুন্দর গন্ধ এখানে! তুমি যে মানুষের গায়ের আলোর কথা বল, সে আলো যে তোমারও রয়েছে। বড় সুন্দর আলোটি-হাঁসের পালকের মতো সাদা-এর মধ্যে কোনো হিংসা নেই, দ্বেষ নেই। এই আলোতে দুদণ্ড বসে থাকতে ইচ্ছে করে।
কেউ বা এসে বলে-তুমি যে আমাকে ওষুধের গাছ চিনিয়েছিল, চিনিয়েছিলে রোগ নির্ণয় করতে, দেখ, সেই পেশায় আমি এখন দাঁড়িয়ে গেছি। একটা সময়ে আমি পড়ে থাকতুম বাবুদের বাড়ির আস্তাবলে, গরু-ঘোড়ার সেবা করতাম, কিন্তু সে কাজে আমার কোনো ক্ষমতা ছিল না। কেউ আমাকে দেখে বুঝতে পারত না যে আসলে ও কাজ আমার নয়। আমার মধ্যে যে বৈদ্য হওয়ার গুণ আছে তা তুমিই বুঝেছিলে। এই দেখ, তোমার জন্য জামাকাপড়, তোমার বউয়ের জন্য শাড়ি-গয়না, তোমার ছেলেপুলেদের জন্য খেলা আর খাবার।
এইভাবে লোকটার সামনে অযাচিত উপহার জমে ওঠে।
যে লোকটা ছিল এ গাঁয়ের বিখ্যাত চোর, সে এসে একদিন সলজ্জ হাসিমুখে প্রণাম করে দাঁড়াল, বলল–আমাকে-মনে আছে তো তোমার? আমি ছিলাম এ-দিকের দশখানা গাঁয়ের বিখ্যাত চোর। রোজ আমি রাতে চুরি করতে বেরোতুম, আর তুমি তোমার দাওয়া থেকে আমাকে ডাক দিয়ে বলতে-ওরে আয় চুরি করতে যাবি তো তার আগে একটু তামাক খেয়ে যা। দুটো সুখ-দুঃখের গল্প করি। তা আমি বুদ্ধিটা মন্দ নয় দেখে এসে বসতাম। তামাক খেতে খেতে পাঁচটা কথা এসে পড়ত। কথায় কথায় যেত ভোর হয়ে। আমি কপাল চাপড়ে চাপাড়ে দুঃখ করে বলতাম—ঐ যা, গেল আমার একরাতের রোজগার। তুমি সান্ত্বনা দিয়ে বলতে–আজ রাতে সকাল-সকাল বেরোস। আবার পারের রাতে তুমি ডাক দিতে। আবার রাত পূইয়ে যেত। আমি মনে মনে ভাবতাম, এই লোকটাই খাবে আমাকে। উপোস করিয়ে মারবে। তাই আমি তোমার দাওয়ার সামনেকার রাঙাটা ছেড়ে অন্য রাস্তা ধরলাম একদিন। কী করে টের পেয়ে মাঝপথে তুমি ছিলে ঘাপটি মেরে ধরলে আবার, কথায় কথায় দিলে রাত পূইরে। রোজ এমন হতে থাকলে আমি একদিন অন্য উপায় না দেখে ধরলাম ঠেসে তোমার পা, বললাম-ঠাকুর, ব্রাহ্মণ হয়ে কেন তুমি আমার অন্ন মারছে! এ যে আমার বৃত্তি। এ না করলে যে ভাতে মরণ! তুমি হেসে বললে–আচ্ছা, আজ বাড়ি যা। তুই আর চুরির ডানিস কী? আমি তোকে চুরির ভাল কায়দা-কৌশল শিখিয়ে দেবো। আজ আমি আবো তোর সঙ্গে। শুনে ভারি ফুর্তি হল মনে। জানতাম, তোমার জানা আছে বিবিধ বিদ্যা। তুমি জানো রসায়ন, জানো গণিত, জানে বলবিদ্যা, জানো পদার্থের গুণ, তুমি সঙ্গে থাকলে আমি হবো চোরের রাজা। সেই রাতে বেরোলাম তোমার সঙ্গে। গল্পে গল্পে পথ হাটছি, যাবো ভিনগয়ে, ধনী মহাজনের দোকান লুটে আনবো দুজনে। মনে বড় ফুর্তি। হঠাৎ মাঝপথে তুমি থমকে দাঁড়িয়ে বললে–হ্যাঁরে, তোর ঘরে না সুন্দরী বৌ আছে। আমি বললাম–তা আছে তো!
তুমি বললে–আরে, তুই না একবার বলেছিলি, তোর পাশের বাড়িতে একটা বদ লোকের বাস, সে লোকটা তোর বৌয়ের দিকে নজর দেয়! আমি বলল–হ্যাঁ, সত্যি। তখন তুমি বললে–তা এই রাতে যদি সে লোকটা তোর ঘরে আসে, তুই তো রাতবিরেতে ফিরিস, তোর বৌ ঘুমচোখে উঠে দরজা খুলে দেয়। সে লোকটা হয়তো তোর গলা নকল করে ডাকবে, আর তোর বৌ উঠে দরজা খুলে দেবে। যদি তাই হয়। রাতবিরেতে এক সুন্দরী বৌকে রেখে বেরিয়েছিস–পাশেই ঘোষের বাসা–কাজটা কি ঠিক হয়েছে? অমনি বিছের কামড়ের মতো মন ছটফট করে উঠল। বললাম–তাই তো। বলে সিঁদকাঠি ফেলে দৌড় লাগালাম ঘরের দিকে। তারপর থেকে সেই বিষ-যন্ত্রণায় আর ঘর থেকে বেরোতে পারি না। রাত হলেই ঘরের বাইরে মন টানে। বাইরে বেরোই তো ঘরের কথা ভেবে ফাপর হয়ে পড়ি। সে এমন টোনায় পড়লাম যে খেতে পারি না, ঘুমোতে পারি না, রোগা হয়ে হাড় বেরিয়ে গেল। তখন আবার গিয়ে তোমার পায়ে পড়লাম–এ কী সর্বনাশ করলে আমার। আমার যে বৃত্তি ঘুচে গেল। অথচ চুরি ছাড়া আর যে আমি কিছুই শিখিনি! এখন কী করে আমার দিন চলবে? তুমি গম্ভীর হয়ে ভাবলে, ভের বললে— তোর যন্ত্রপাতিগুলো আন তো। এনে দেখালাম। তুমি সেসব দেখে-খে বললে-তুই তো তালাচাবির কলকব্জা ভাল চিনিস। জানিস এদের মরকোচ। দেখ তো ভাল তালা বানাতে পারিস কিনা- যে তালা চোর খুলতে পারে না। এইসব যন্ত্রপাতি তোর সবই কাজে লাগবে তাতে। তোমার সেই কথামতো মনের দুঃখে অগত্যা তালা তৈরি করতে লাগলাম। আস্তে আস্তে সেসব তালার সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। এখন শহরে আমার ফলাও কারবার। পাঁচজন আমাকে ভদ্রলোক বলে সম্মান করে।