কোনো লোই তার এইসব কথা ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। সেসব বিচিত্র আলোর বর্ণনা দিত মায়ের কাছে, বন্ধুর কাছে। তারা বলেছে পাগল।
সংসারী মানুষের আছে সুখবোধ। গৃহস্থ সুখ পায় পুত্ৰমুখ দেখে, নিজের সঞ্চয় দেখে। যত কিছু সে অধিকার করে পৃথিবীতে তত তার সুখ। লোকটার তেমন সুখ নেই। কিন্তু মাঝে-মাঝে তার অদ্ভুত এক আনন্দ আসে। একা একা সেই অকারণ আনন্দের প্লাবনে ভেসে যেতে যেতে সে চিৎকার করে ছেলে-বউকে ডাকে, ডাকে চেনা লোকেদের, সেই আনন্দে সবাইকে সামিল করতে। বস্তুত কেউই তার সেই আনন্দকে বুঝতে পারে না। লোকটা অবাক হয়ে ভাবে, তবে বুঝি আমি পাগলই! আমার একার জন্যই বুঝি কিছু দৃশ্য আছে, কিছু শব্দ আছে, আছে অপার্থিব আনন্দ।
মাঝে-মাঝে ক্ষেত্রে কাজ করতে করতে, পোয়াল নাড়া বাঁধতে বাঁধতে, গোয়াল পরিষ্কার করতে করতে, হঠাৎ চমকে উঠে ভাবে–আরে! আমি লোকটা কে। আমি এখানে কেন? এতো আমার ক্ষেত নয়। এতো নয় আমার বাড়িঘর! আরে! আমি যেন কোথায় ছিলাম–কোথায় ছিলাম! সে যে এক গভীর নীল স্নিগ্ধ জগৎ। সেখানে এক অদ্ভুত আলো ছিল। ছিল এক বিচিত্র সুন্দর শব্দ! সেই আমার জগৎ থেকে কে আমাকে এখানে আনল? কেন আনল এই মৃতুশীলতার মধ্যে, হঠাৎ সে চমকে উঠে বোধ করে–যে পথ দিয়ে আমি এসেছিলাম সেই পথের দুধারে ছিল অনেক তারা নক্ষত্র। সেই বীথিপথটি অনন্ত থেকে চলে গেছে অনন্তে। তার শুরু নেই শেষও নেই। সেই পথে চলতে চলতে কেন আমি থেমে গেলাম। নেমে এলাম এইখানে? এই কথা ভেবে লোকটা চারদিকে চেয়ে এক সম্পূর্ণ অচেনা ভুত অপার্থিবতাকে বোধ করে। কোনো কিছুকে সে আর চিনতে পারে না
সংসারী মানুষদের কাছে ক্ষেতখামার পশুপাখি গাছপালা ছেলেবউ। এই সবের সঙ্গে তার কোন মেখেকুরে থাকে। তারা নিজের জিনিস চেনে, চেনে পরের জিনিস। তারা সেসব জিনিমে নিজেদের চিহ্ন দিয়ে রাখে। অবিকল তাদের মতোই এই লোকটারও আছে সব। কিন্তু তাতে তার চিহ্ন দেওয়া নেই। বউ রাগ করে–তোমার বাড়ি তো বাড়ি নয়, এ হচ্ছে হাট। সারাদিন এখানে লোক আছে যায়। তোমার দিন কাটে দাওয়ায় বসে। কখনো বা বলে–তুমি অন্যের ক্ষেত থেকে পাখি-পাখালি তাড়াও, ছাগল-গরু তাড়াও, অন্যের অসুখের দাও ওষুধ, অন্যের দুঃখে গলে পড়ো। আমাদের ওপর তোর মন নেই। অথচ আমরাই তোমার আপনজন, আর এ সমস্ত তোমার নিজের জিনিস।
লোকটা ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারে না। কেমন গুলিয়ে যায়। মাঝে-মাঝে সে যে নিজেকেই অনুভব করতে পারে না ঠিকমতো, তবে নিজের বলে কী অনুভব করবে।
এ কথা সত্য যে মানুষটি পৃথিবীকে ভালবেসে গলে যায়। গলে যায় মানুষের দুঃখ দেখে। গৃহস্থের এরকম হাতে নেই। গৃহস্থাকে এরকম হতে নেই। গৃহস্থকে আরো শক্ত হতে হয়, হতে হয় হিসেবি সঞ্চয়ী, তার চাই আত্মপর ভেদজ্ঞান। তার বউ বলে–আরো পাঁচ জনকে দেখ। দেখ, তারা নিজেদের ঘরে বাস করে। তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি আছো পরের ঘরে।
লোকটার বউ বলে এ কথা। লোকটার বুড়ি মাও বলে। বেঁচে থাকতে লোকটার বাবাও বলত-এ সংসারে তুমি দুঃখ পাবে বলেই জন্মেছ।
লোকটা অন্যরকম বোঝে। সে যখন দাওয়ায় বসে দূরের গাঢ় ধূসর পাহাড়টিকে দেখে, যখন দেখে ময়ূরপুচ্ছের মতো নীল আকাশ কিংবা নিষ্পাপ শিশুর মুখ, তখন যে অনাবিল আনন্দকে সে টের পায়, সে আনন্দ তো নিজের। সে আনন্দের কারণ হোক না তার নিজের শিশু কিংবা দূরের পাহাড় কিংবা আকাশ-না কিনা সংসারের বাইরে–তার সৌন্দর্য। তবে তো আনন্দই নিজের, সেই আনন্দই আপন করে তোলে এই বিশ্বসংসারকে। যে জানে সে জানে, পরবলে কিছু নেই।
জলে ডুবে মারা গেছে একটি শিশু। বাপ তার মৃত শিশুকে ধ্বীর ঢেকে কোলে নিয়ে চলেছে। লোকটা থেমে চেয়ে থাকে। দেখে শিশুটির মুখখানা ঢাকা, তবে পা দুটি কেবল ঝুলে আছে। সেই শিশুটিকে কোনোদিনই দেখেনি লোকটা। আজও দেখল না। কেবল সেই চির অপরিচিত শিশুটির দুখানা পা দেখে রাখল। বুকখানা ব্যথিয়ে উঠল তার। হহ করে কান্না এল। অচেনা বাপটির মুখ দেখে ফেটে গেল বুক। বড় অবাক হল সে। ভাবতে বসল, কেন এরকম হবে। যাকে কোনদিন দেখিনি, যে আমার চেনা ছিল না, তার জন্য কান্না কেন। তাহলে কি যাদের পর করে রেখেছি তারা আমার যথার্থ পর নয়? ঐ যে এক মুহূর্তের একটু দুঃখ তা কি কাটার মতো নির্ভুল বলে দেয় না যে, ঐ অপরিচিত শিশুটিও ছিল আমারই জন। যেমন দূরের দেশে অকাল এলে, মড়ক লাগলে মানুষের প্রাণ ছটফট করে। ঐ একটু দুঃখ কি কয়েক পলকের জন্য দূর ও নিকট, আপন ও পরের ভেদরেখা মুছে দেয় না? চাবুকের মতো চকিতে আঘাত করে না মানুষের স্বার্থপরতাকে?
গাঁয়ের বুড়ো মাতব্বরা শুনে বলে তুমি বাপু আহাম্মক। অচেনা একটা জ্বলে ডোবা শিশুকে দেখে তোমার যে দুঃখ তা তো আসলে তোমার নিজের ছেলের কথা ভেবেই। ঐ যে অচেনা বাপটির মুখে তুমি শোক দেখলে, ঐ বাপের জায়গায় তুমি দেখেছে নিজেকেই। মানুষ কি পরের জন্য দুঃখ পায়। দুঃখ পায় নিজের যদি ঐ অবস্থা হয়–এই ভবে। দূরের দেশের আকাল কি মড়কের কথা শুনে লোকে যে অস্থির হয়, তা তার নিজের দেশের কথা মনে করেই। পরের জন্য যে দুঃখ, তা আসলে নিজেরই প্রক্ষোপ।
লোকটা উঠে পড়ে। ভাবতে ভাবতে যায়; মাঝপথে ক যেন মনে পড়ে। অনি ফিরে এসে মাতব্বরদের সবচেয়ে প্রবীণ মানুষটাকে বলে-বুড়োমশাই, পূর্ণিমা কি