- বইয়ের নামঃ সুখ দুঃখ
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. সে ভালবাসে গাছগুলিকে
লোকটা সারাদিন তার ক্ষেতে কাজ করে। একা একা, সে মাটির সঙ্গে কত ভালবাসার কথা বলে! আল তুলে জল বেঁধে রাখার সময়ে সে ঠিক যেন এ পিপাসার্তকে জলদানের তৃপ্তি পায়। সে ভালবাসে গাছগুলিকে। যারা ফল দেয়, ছায়া দেয় দূরের মেঘকে টেনে আনে। সে প্রতিটি গাছে সুখ-দুঃখকে বোধ করার চেষ্টা করে। সে ভালোবাসে তার গৃহপালিতগুলিকেও। সে বোঝে, প্রতি-প্রত্যেকের টান-ভালবাসার ওপর সংসার বেঁচে আছে।
পাপপুণ্যময় দিনশেষে সে তার নির্জন নিকোনো ওয়াটিতে বসে। গুড়গুড় করে তামাক খায়। অন্ধকারে ময়ূরপুচ্ছের মতো নীল আকাশে দেবতার চোখের মতো উজ্জ্বল তারা ফুটে ওঠে। সে সেই হিম, নিথর ঐশ্বর্যের দিকে চেয়ে থাকে। দেখে বিশাল ছায়াপথ, ঐ পথ গেছে তার পূর্বপুরুষদের কাছে। কখনো ফুটফুটে জোৎস্নায় উঠোনে খেলা করে তার তিনটি শিশু ছেলেমেয়ে। সে মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে থাকে। সে কখনো সেই নিথর আকাশকে কখনো বা সেই নিষ্পাপ তিন শিশুকে উদ্দেশ্য করে বিড়বিড় করে বলে–আমি তোমাদের কাছে কোনো লাভ-লোকসান চাই না। তোমরা আমাকে অনাবিল আনন্দ দিও।
সারারাতই প্রায় সে জেগে থাকে। গোয়ালঘর থেকে গুরুর পানোর শব্দ পেলে উঠে গিয়ে মশা কিংবা উঁশ তাড়ায়। টেমি হাতে চলে আসে হাঁসের ঘরে। দেখে, তাদের ডিম স্বচ্ছন্দে প্রসব হয়েছে কিনা। ঝড়ের রাতে সে উঠে চলে যায় বাগানের গাছগুলির কাছে। বাঁশ-কাঠের ঠেকনো দিয়ে রাখে বড় গাছগুলিতে।
মাঝে মাঝে অন্ধকার নিশুত রাতে বারান্দায় বসে সে যখন তামাক খায়, তখন তার বউ আর ছেলেমেয়েরা ঘরে ঘুমোয়, ঘুমোয় তার গাছপালা, তার গৃহপালিতরা, লোকটা তখন একা জেগে দেখে, দূরের মাঠ ভেঙে ধোঁয়াটে লণ্ঠন হাতে অস্পষ্ট কার। যেন চলে যাচ্ছে, কানে আসে ক্ষীণ হরিধ্বনি। কখনো বা দেখে, ভিন গাঁয়ের দিকে মশাল হাতে চলেছে একদল লোক, তাদের হাতে বন্দুক, সড়কি, খাড়া, মুখে ভুসোকালি মাখা। লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ে থাকে। তার আর ঘুম আসে না।
গ্রামের ধারে রুপোলি নদীটির পাশে শিবরাত্রি কি রথযাত্রার মেলা বসে। কত দূর থেকে রঙে ছোপানো জামাকাপড় পরে আসে অচেনা মানুষেরা। রঙিন ছেলেমেয়েরা মুখোশ পরে ঘোরে, বাজিকর খেল দেখায়।পায়ে পায়ে রাঙা ধুলোর মেঘ ওড়ে। ছেলের হাত ধরে লোকটি মেলায় আসে। ছেলেকে ডেকে বলে–মানুযের মুখ দেখ বাবা, মানুষের মুখ দেখ। এর বড় নেশা। হাটুরেরা ঘোরেফেরে, দরদাম করে। লোকটা কেনাকাটার ফাঁকে ফাঁকে অচেনা হাটুরেদের দেখে আর দেখে। কখনো বা ছেলেকে বলে–অচেনা মানুষকে একটু পর-পর লাগে রটে, কিন্তু আপন করে নেওয়া যায়। কাটা শক্ত না।
সে জানে দেশের আইন, জমি এবং ফসলের মাপ, অঙ্কের হিসেব, লোকটা জানে চিকিৎসাবিদ্যা। সে জানে, কোন উদ্ভিদের কী গুণ, কোন মাটিতে কোন ফসল, কোন বীজ থেকে কী গাছ। তাই এ গা সে গাঁ থেকে নানাজন আসে তার কাছে। আইন জেনে যায়। জমির মাপ জেনে যায়, আসে চিঠি লেখাতে কিংবা হিসেব মিলিয়ে নিতে। লোক আসে রোগের ওষুধ জানতে। সে কেবল মানুষকে দেখে আর দেখে। সে জানে, পৃথিবীর কোন কিছুই একটি ঠিক আর একটির মতো নয়। আছে বর্ণভেদ। আছে বৈশিষ্ট্যের তফাত। এক গাছের দুটি পাতাও নয় এক রকমের। সে মানুষে মানুষে সেই ভেদ দেখতে পায়। দেখে বৈশিষ্ট্য। তাই প্রতিটি মানুষের জন্য তার আলাদা বিধান; আলাদা ব্যবহার আলাদা ওষুধ। এক-একটি মানুষের অর্থ এক-একটি আলাদা জগৎ। প্রতিটি মানুষেরই আছে অস্তিত্বের বিকিরণ। মানুষ দেখতে দেখতে লোকটার এমন অবস্থা হয়, যে সে মানুষের সেই বিকিরণটি অনুভব করে। সেই বিকিরণ অনেকটা আলোর মতো বিভিন্ন মানুষের আলোর রঙ আলাদা। বড় সরল লোক সে। সে ভাবে তার মতো আর সবাইও মানুষের বিকিরণ দেখতে পায়। তাই সে কখনো হয়তো কোনো লোককে দেখে চেঁচিয়ে বলে–এঃ হেঃ তোমার আলোটা যে লাল গো–বড্ড লাল। ও যে রাগের রঙ।
শুনে লোকে হাসে, বলে পাগল।
লোকটা নানারকমের আলো দেখেছে জীবনে। কখনো পাঠশালা থেকে ফেরার পথে-যখন বর্ষার ভারী মেঘ নিচু হয়ে ঘন ছায়া ফেলেছে চরাচরে–ঝুমকো হয়ে এসেছে আলো–তখন মহাবীরথানের বটগাছ পেরোবার সময়ে লোকটা হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। অবাক হয়ে দেখেছে, তার সামনে এক আলোর গাছ। আলোর ঝালর তার পাতায় পাতায়, কাণ্ডে, ডালে। তারপর সে চারিদিকে চেয়ে দেখছে হঠাৎ যেন পাল্টে গেছে পৃথিবীর রূপ। বাতাসে মাটিতে শূন্যে সর্বত্রই আলোময় কণা। খেলা করছে চরাচর জুড়ে আলোর কণিকাগুলি। সে দেখল নানা রঙের আলো ছাড়া আর কিছু নেই। সেই কণাগুলিই খেলার ছলে তৈরি করছে গাছপালা, মাটি, মেঘ। তারাই ঘুরছে ফিরছে, তৈরি করছে সবকিছু, আবার ভেঙে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে অন্য চেহারায়। এই বিচিত্র দৃশ্য দেখে সে ভয় পেয়ে চোখ বুজল। টের পেল, তার দেহ জুড়ে সেই কণাগুলিরই খেলা চলেছে। মাঝে-মাঝেই সে সেই কণাগুলিকে দেখতে পেত, ভাবত–তবে কি সৃষ্টির সত্য চেহারাটা এই যে, তা আলোময় এবং কণিকাময়? কখনো কখনো সে দেখেছে সেই কণাগুলির চলাফেরা ছন্দময় যেন এই মহাবিশ্বের কোনো অশ্রুত সঙ্গীতের সঙ্গে তারা সুরে বাঁধা। তাদের দোলা এবং চলা সেই ছন্দটিকে প্রকাশ করছে।