দাদু হতাশ গলায় বললেন, না, তুমি দেখছি আমাকে না মেরেই ছাড়বে না। লোকটা তাড়াতাড়ি বলল, মরার কথা বলিনি, বাস্তব অবস্থাটা বোঝাতে চাইছিলাম।
দাদু বললেন, বাস্তব অবস্থাটা আমিও কি আর বুঝি না? এ বাড়িতে আর কেউ না থাক গাছপালাগুলো তো আছে। সেগুলোর মায়াই কি কম! চট করে বেহাত হতে দিই কী করে?
গাছপালায় কেউ হাত দেবে না। যেমন আছে তেমনই থাকবে না হয়।
সে তুমি এখন বলছ। জমি রেজিষ্ট্রি হয়ে গেলেই অন্যরকম। যে টাকা ফেলে জমি কিনছে সে কি আর বুড়ো মানুষের মুখ চেয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? পারিজাত অত ভাল মানুষ নয়।
আচ্ছা, বায়নানামাটা অন্তত করে রাখতে দিন।
তুমি বরং সামনের শুক্কুরবার এসো।
কতবার তো ঘুরে আসতে বললেন। আমিও এসে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছি। শুক্রবার কিন্তু দাদা কথা দিতে হবে।
এত তাড়া কীসের বলো তো! একটু রয়ে বয়ে যোক না।
লোকটা বলল, দেরি করলে আবার সব কেটে যাবে যে। জমি আপনার নামে। কিন্তু আপনার অবর্তমানে আপনার তিন ছেলে আর দুই মেয়ে ওয়ারিশান। তখন আবার সকলে এককাট্টা না হলে জমি হস্তান্তর হবে না। ঝামেলাও বিস্তর।
দাদু এবার একটু ঘেঁকিয়ে উঠে বললেন, শুক্কুরবার অবধি আমি বর্তমানই থাকব।
লোকটা শশব্যস্ত বলল, না, না, সে তো ঠিকই। তাহলে ওই পাকা কথা বলে ধরে নিচ্ছি। শুকুরবার না হয় বায়নার টাকাটাও নিয়ে আসব।
আবার সাইকেলের শব্দ পেয়ে আমি ঘাড় উঁচু করে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করলাম। মুখটা দেখা গেল না। তবে বেশ দশাসই চেহারা।
উঠে দাদুর কাছে এসে বসলাম সামনের বারান্দায়।
লোকটা কেন এসেছিল দাদু? বাড়িটা কি তুমি বেচে দেবে?
দাদু একটু বিব্রতভাবে বললেন, না বেচেই বা কী হবে?
আমার এখানে একটা চাকরি হওয়ার কথা চলছে। যদি হয় তবে আমার ইচ্ছে ছিল এ বাড়িতে থেকেই চাকরি করি।
চাকরি? কীসের চাকরি?
মাস্টারি।
ও বলে দাদু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর আমার দিকে চেয়ে বলেন, সত্যিই থাকবি নাকি?
যদি চাকরি পাই।
দাদু যেন কথাটায় বেশি ভরসা পেলেন না। বললেন, রোজই লোক আসে। তবে আমি কাউকে কথা দিইনি।
বিকেলে পারুলদের বাড়ি থেকে একটা সাইকেল চেয়ে নিয়ে শহরে রওনা হলাম। আজ বিকেলেই অসীমা দিদিমণির সঙ্গে দেখা করার কথা। গণেশকাকা নিয়ে যাবেন।
পথে ঝিরঝিরে একটু বৃষ্টি হয়ে গেল! ভিজলাম। আকাশ জমাট মেঘে থম ধরে আছে। রাত্রে প্রচণ্ড বৃষ্টি হতে পারে।
গণেশকাকার দোকানে সাইকেল রেখে দুজনে রিকশা নিলাম। যেতে যেতেই জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের গাঁয়ের ওদিকে স্যাটেলাইট টাউনশিপ হচ্ছে বলে কিছু শুনেছেন?
গণেশকাকা বললেন, কত কিছুই তো হবোহবো হয়। দেখা যাক শেষ অবধি। তবে শুনেছি হচ্ছে।
আজ একজন লোক আমাদের বাড়িটা দিবার জন্য এসেছিল।
কে বল তো!
তা জানি না। শুনলাম পারিজাতবাবুর লোক।
গণেশকাকা সরল সোজা মানুষ। নামটা শুনেই জিব কেটে বললেন, ও বাবা, সেই তো স্কুলের সেক্রেটারি।
শুনে বুকটা হঠাৎ দমে গেল। বললাম, নোকটা কেমন?
ভাল তো কেউ বলে না। তবে টাকা আছে, ক্ষমতা আছে। আজকাল ওসব যার আছে সেই ভাল।
এ লোকটাই কি তার বউকে খুন করেছিল?
লোকে তো তাই বলে। তোকে কে বলল?
ফুলমাসি।
গণেশকাকা একটু চুপ করে থেকে বলল, পারিজাত অনেকদিন ধরেই তোদের বাড়ি কিনতে চাইছে। তোর দাদু অবশ্য রাজি হয়নি।
আমার মনটা খারাপ লাগছিল। স্কুলের চাকরিটা আমার হবে না জানি। তবু তো আশার বিরুদ্ধেও মানুষ আশা করে। এখন পারিজাতবাবু যদি জানতে পারেন যে জমিটা আমাদের এবং আমরা বেচতে রাজি নই তবে হয়তো চটে যাবেন, আর আমার চাকরিটাও হবে না।
বিচিত্র এই কার্যকারণের কথা ভাবতে ভাবতে আমি বললাম, অসীমা দিদিমণির কি চাকরির ব্যাপারে সত্যিই হাত আছে?
দেখাই যাক না।
পারিজাতবাবু লোকটা কে? আগে নাম শুনিনি তো!
এখানকার লোক নয়। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।
অসীমা দিদিমণির জন্য তাদের বাইরের ঘরে আমাদের অনেকক্ষণ বসে থাকতে হল। উনি এখনও ফেরেননি। আমার হাই উঠছিল। গণেশকাকা কেমন যেন শ্রদ্ধার সঙ্গে জবুথবু হয়ে বসেছিলেন। যেন এইসব শিক্ষিতজনের ঘরবাড়ি আসবাবপত্রকেও সমীহ করতে হয়।
গণেশকাকাকে আমি কাকা ডাকি, অথচ তার বউকে মাসি। কেন ডাকি তা নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবলাম। কোনও সূত্র পেলাম না। ছেলেবেলা থেকেই ডেকে আসছি, এইমাত্র। পারুলের সঙ্গে আমার বিয়ে হলে অবশ্য সম্পর্ক এবং ডাক পালটে যেত। ফুলমাসিকে মা বলে ডাকতে অসুবিধে হত না, কিন্তু গণেশকাকাকে গাল ভরে বাবা ডাকতে পারতাম না নিশ্চয়ই। পারুলের শ্বশুরবাড়ি এই শহরেই। আমি কখনও যাইনি। কালেভদ্রে দেশের বাড়িতে এলেও আমি পারুলের শ্বশুরবাড়িতে যাই না ভয়ে। যদি ওরা কিছু মনে করে?
এইসব ভাবতে ভাবতেই অসীমা দিদিমণি ঘরে ঢুকলেন। তটস্থ গণেশকাকা উঠে হাত কচলাতে লাগলেন। মুখে একটু নীরব হেঁ-হেঁ ভাব।
অসীমা দিদিমণির মতো এরকম বিষণ্ণ চেহারার মহিলা আমি খুব কম দেখেছি। চেহারাটা রুক্ষ এবং শুকনো। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। ওঁর চোখমুখ যেন গম্ভীর হতাশা, গভীর ক্লান্তি এবং ব্যর্থতার গ্লানিতে মাখা। একটুও হাসির চিহ্ন নেই কোথাও। আমার পরিচয় পেয়ে গভীর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। কিন্তু মনে হচ্ছিল, আমাকে নয়, উনি মনের মধ্যে অন্য কোনও দৃশ্য দেখছেন।
৩. পারিজাত
৩। পারিজাত