একদিন আমতলায় খড়ের গাদির পিছনে নিরিবিলি কথা হল।
পারুল বলল, আমি তোমার ওপর রাগ করেছি।
কেন?
করেছি ইচ্ছে হয়েছে। আসতে চাও না কেন এখানে?
এখানে এসে কী হবে? আমি পড়ছি যে কলকাতায়।
আর কত পড়বে?
অনেক পড়া।
আমি বুঝি কেবল হাঁ করে বসে থাকব?
আমি কী করব বলল তো?
এত লম্বা হয়েছ কেন? তোমাকে চেনাই যায় না।
লম্বা হওয়ারই তো কথা।
তা বলে এতটা ভাল নয়। ভীষণ অন্যরকম হয়ে গেছ।
মানুষ তো বয়স হলে বদলে যায়।
আমি বদলেছি?
খুব।
কীরকম বদলেছি?
তুমিও লম্বা হয়েছ।
সুন্দর হইনি তো?
বাঃ, তুমি তো দেখতে ভালই।
তোমার চেহারাটা খুব চালাক-চালাক হয়ে গেছে কেন বলো তো!
তবে কি বোকা-বোকা হওয়ার কথা ছিল?
তা নয়। বলে একটু লজ্জা পেল পারুল। যুবতী বয়সের একটা চটক প্রায় সব মেয়েরই থাকে। পারুলেরও আছে। কিন্তু তা বলে পারুলকে সুন্দর বললে ভুল হবে। যদি কলকাতায় না হয়ে এই গ্রামেই থাকর্তামা তাহলে পারুলকে আরও অনেক বেশি সুন্দর মনে হত। কিন্তু আমি যে শহরে নিত্যদিন বহু সত্যিকারের সুন্দর মেয়ে দেখি।
অবশ্য শুধু সৌন্দর্যটাই কোনও বড় কথা নয়। পারুল বড় ভাল মেয়ে। শান্ত, ধীর, লাজুক, বুদ্ধিমতী। তার হৃদয়টি নরম। আজকাল মনে হয়, তার সঙ্গে বিয়ে হলে আমি সুখীই হতাম। কিন্তু আমাকে বিয়ের জন্য আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে, যদি আদপেই করি। পারুল ততদিন অপেক্ষা করতে পারত না। তার বয়স হয়ে যাচ্ছিল।
তবু আশা করেছিল পারুল। খুব আশা করেছিল। কিন্তু আমি কোনও অসম্ভব প্রস্তাব তো করতে পারি না। আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভাল নয়। আমার তখন মাত্র আঠারো-উনিশ বছর বয়স। স্বপ্ন দেখার পক্ষে সুন্দর বয়স, কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার মতো বয়স সেটা নয়। তার ওপর বর্ণ আলাদা। সেটা নিয়েও কিছু ঝামেলা হতে পারত। শহরে বাস করার ফলে আমার বাস্তব বুদ্ধি কিছু বেড়ে থাকবে।
পারুলদের অবস্থা বেশ ভাল। ওরা জাতে গোপ। বংশগত বৃত্তি ওরা কখনও ছাড়েনি। বাড়ির পিছন দিকে সেই আমতলার ধারেই মস্ত উঠোন ঘিরে টানা গোশালা। অন্তত কুড়ি-পঁচিশটা গোরু মোষ। দুধ বিক্রি তো আছেই, উপরন্তু শহরের বাজারে এবং রেল স্টেশনে রমরম করে চলছে দুটো মিষ্টির দোকান। আমাদের মতো ওরাও এসেছিল তখনকার পূর্ব-পাকিস্তান থেকে। কিছু কষ্টেও পড়েছিল বটে, কিন্তু সামলে গেছে। এখনও ওদের বাড়িতে ঢুকলে সচ্ছলতার সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। মস্ত জমি নিয়ে বসত। অন্তত গোটা তিনেক একতলা এবং দোতলা কোঠাবাড়ি। একান্নবর্তী পরিবার অবশ্য ভাঙছে ভিতরে ভিতরে। তবে বাইরে থেকে অতটা বোঝা যায় না।
পারুলের মাকে আমি ফুলমাসি বলে ডাকি। ফরসা গোলগাল আহ্লাদি চেহারা। একটু বেঁটে।
খবর পেয়েই বেরিয়ে এসে বললেন, আয়। কালও তোদের কথা ভাবছিলাম।
কী ভাবছিলে?
এমনি ভাবছিলাম না। রাতে একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখলাম তোর মাকে নিয়ে। শানুদি ভাল আছে তো?
আছে। স্বপ্নের কোনও মানে হয় না কিন্তু।
সে হয়তো হয় না। তবে মনটা কেমন করে যেন।
পারুল কি শ্বশুরবাড়ি?
তাছাড়া আর কোথায়?
বারফট্টাই নেই বলে এদের ঘরে আসবাবপত্র বেশি থাকে না। যা আছে তাও তেমন চেকনাইদার নয়। সাদামাটা সাবেকি খাট, চৌকি, চেয়ার, আলমারি, দেয়াল-আয়না, সস্তা বুক র্যাক।
পারুলের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা দুবাড়ির সকলেই জানত। ফুলমাসির সমর্থনও ছিল। সম্ভাব্য জামাই হিসেবে উনি আমাকে একটু বাড়াবাড়ি রকমের যত্নআত্তি করতেন। সেই অভ্যাসটা আজও যায়নি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বেশ বড় রকমের আয়োজন করে ফেললেন।
আমি মৃদু হেসে বললাম, ফুলমাসি, যাদের ভাল করে খাওয়া জোটে না তাদের ভাল খাইয়ে অভ্যাস খারাপ করে দেওয়াটা খুব অন্যায়।
খুব পাকা হয়েছিস, অ্যাঁ? পেট ভরে খা তো।
পেট ভরে খাব না কেন? আমার তো চক্ষুলজ্জার বালাই নেই। তবে ভাল ভাত বা তেঁতুল পান্তা দিলেও পেট ভরেই খেতাম, এত আয়োজন করার দরকার ছিল না।
আচ্ছা, এর পর পান্তাই দেব। এখন খা। তুই নাকি শিবপ্রসাদ হাই স্কুলে চাকরি পেয়েছিস?
কে বললে?
পারুলের বাবা বলছিল।
গণেশকাকা? গণেশকাকাই তো আমাকে চিঠি লিখে আনিয়েছে। শিবপ্রসাদ হাই স্কুলে লোক নেবে খবর দিয়ে।
তুই ওর চিঠি পেয়ে এসেছিস? দেখ কাণ্ড! আমাকে বলল অভির চাকরি হয়েই গেছে।
না গো মাসি। শহরে নেমেই আগে স্টেশনের কাছের দোকানটায় গিয়ে গণেশকাকার সঙ্গে দেখা করেছি। শুনলাম দুজন লোক নেবে, অ্যাপলিক্যান্ট ছ’শরও বেশি।
বলিস কী?
গণেশকাকা আমাকে চিঠি লিখে আনিয়ে এখন ভারী অস্বস্তিতে পড়েছেন।
তোর কি তাহলে হবে না?
হওয়ার কথা তো নয়। তবে গণেশকাকা একজনকে মুরুব্বি ধরেছেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমিসট্রেস। অসীমা না কী যেন নাম।
ও, সেই শুঁটকি! ওকে ধরলে কি কাজ হবে? ওর বরটা বরং করে দিতে পারে।
ও বাবা, আমি অত ধরাধরিতে নেই।
তা সে তুই কেন ধরতে যাবি! যে তোকে আনিয়েছে সেই ধরবে।
শুঁটকির বরটা কে?
ফুলমাসি মুখটা সামান্য ঘুরিয়ে নিয়ে বলেন, বর আসলে নয়। বিয়ের কথা চলছে। লোকটা ভাল নয়। আগের বউটাকে গলা টিপে মেরেছে।
তবে তো শাহেনশা লোক।
লোক খারাপ, তবে চাকরিটা করে দিতে পারে।
কলকাতা ছেড়ে আসার ইচ্ছে আমার খুব একটা নেই। সেখানে কর্মহীন দিন আমার অকাজে কাটে বটে, কিন্তু বোজ মনে হয়, চারদিকে এই যে এক অন্তহীন শহর, এত অফিসবাড়ি, এত দোকানপাট, এত ব্যাবসা বাণিজ্য, হয়তো একদিন এ শহর দুম করে একটা সিংহদুয়ার খুলে দেবে সৌভাগ্যের। কলকাতায় কত ভিখিরি রাজা বনে গেছে। কলকাতায় থাকলে এই সুখস্বপ্নটা দেখতে পারি। কিন্তু মফস্বল শহরে স্বপ্নের কোনও সুযোগ নেই। মনমরা, চোখবোজা হয়ে পড়ে আছে লক্ষ্মীছাড়া এইসব শহর। এদের রসকষ সব টেনে নিয়েছে কলকাতা। এগুলো শুধু বকলমে শহর। মানুষ আর বসতি বাড়ছে বটে, কিন্তু বাড়ছে না অর্থনীতি। তাই এখানে মাস্টারির চাকরিতে আমার তেমন আগ্রহ নেই। হলে ভাল, না হলে ফের স্বপ্ন দেখার শহরে ফিরে যাব।