বললাম, ঠিক জানেন?
পারিজাত হাসল। বলল, জানি। কিন্তু এর বেশি হিরো হতে যেয়ো না। বিপদে পড়বে।
আমার ইচ্ছে হয়েছিল, জামার কলারটা একটু তুলে দিই। তার বদলে খুব আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে একটু হাসলাম। প্রথাসিদ্ধ মস্তানদের দিন কবেই শেষ হয়ে গেছে। এক সময়ে খুদে খুদে নকশাল ছেলেদের ভয়ে তাদের আমি প্রাণভয়ে পালাতে দেখেছি।
পারিজাত আমার মুখের দিকে চেয়ে স্পষ্টই আমার ভিতরটা দেখে নিয়ে বলল, তুমি অবশ্য নকশাল ছিলে। ভয়ডর কিছু কম। তাই না?
আমি গোমড়া মুখ করে রইলাম।
পারিজাত খুব আস্তে করে বলল, নিমকহারাম।
আমি ছ্যাঁকা খাওয়ার মতো চমকে উঠে বলি, কী বললেন?
নিমকহারাম।
তার মানে?
লজ্জা করে না?
কী বলছেন স্পষ্ট করে বলুন।
হৃদয়হীন। অকৃতজ্ঞ।
আমি চটে উঠে বলি, খামোখা গালমন্দ করছেন কেন?
করা উচিত বলে।
আমি কী করেছি?
এই ঘোরতর বেকার সমস্যার যুগে তুমি একটা ভদ্র চাকরি পেয়েছ।
তাতে কী হল?
চাকরিটা পেয়েছ আর একজনের বদান্যতায়।
সে আবার কে?
যাক, অকৃতজ্ঞতা তাহলে ডিপ রুটেড! এর মধ্যে তাকে ভুলতেও শুরু করেছ! অ্যাঁ।
আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই নোকটার অদ্ভুত আচরণে। কিন্তু তেজের গলায় বলি, আমি কারও বদান্যতার ধার ধারি না।
ধারো না, তার কারণ তুমি জেনুইন অকৃতজ্ঞ।
আমি অকৃতজ্ঞ নই।
পারিজাত চট করে তার টেম্পোটাকে একটু নামিয়ে এনে বলে, নও?
না।
তুমি তোমার দেশকে ভালবাসো? জনগণকে?
এ প্রশ্ন অবান্তর।
পারিজাতের দুটো চোখ চিকচিক করতে থাকে। বলে, যারা শ্রেণিশত্রু নয় তাদের কথা বলছি। তাদের ভালবাসতে তো অসুবিধে নেই?
আমি আপনার কথা ধরতে পারছি না।
ধরার দরকার নেই। যা জিজ্ঞেস করছি তার জবাব দিয়ে যাও না।
আপনি আমাকে প্যাঁচে ফেলতে চান বলে মনে হচ্ছে।
বুদ্ধি তো বেশ টনটনে দেখছি।
আমি নির্বোধ নই, আপনিও জানেন।
জানি, হাড়ে হাড়ে জানি। মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টায় তুমি তিন-তিনজন কঠোর মহিলার স্ট্রং রেকমেনডেশন জোগাড় করে ফেলেছিলে।
ও কথা থাক। কাজের কথায় আসুন।
আমি কাজের কথাই বলছি। তুমি জনগণ এবং সর্বহারাদের ভালবাসো কি না।
হয়তো বাসি।
তুমি একটা চাকরি পেয়েছ কি না।
পেয়েছি।
তা হলে?
তা হলে কী?
জনগণের প্রতি তোমার কোনও কর্তব্য আছে কি না।
সব সময়েই আছে।
পারিজাত একটু ঝুঁকে বসে আমার চোখের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে থেকে বলে, জনগণের মধ্যে বিশেষ একজন তোমার জন্য অনেকটাই ত্যাগ স্বীকার করেছিল। প্রায় আত্মোৎসর্গ। মনে পড়ে?
সে কে?
তাকে ভুলে যাওয়াটা অপরাধ অভিজিৎ।
আমি বিরক্ত মুখে বলি, আপনি কি প্রতিমার কথা বলছেন?
পারিজাত একটা শ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দেয়। মৃদু স্বরে বলে, যাক। নামটা অন্তত মনে আছে।
প্রতিমার কী হয়েছে?–আমি জিজ্ঞেস করি।
কী হবে? একজন নিম্ন-মধ্যবিত্তের যুবতী মেয়েদের জীবনে কী আর হয়? কিছুই হয় না। তারা বসে থাকে। অপেক্ষা করে। চাকরি বা বিয়ে কিছু একটা আশা করতে থাকে। শেষ অবধি হয়তো কোনওদিনই হয় না। তুমি কি জানো, বেকার সমস্যার মতো এইসব অনূঢ়া কন্যাদেরও একটা বিশাল সমস্যা রয়েছে এ দেশে?
জানব না কেন? আমারও দুটো বোনের বিয়ে বাকি।
তুমি জানো যে, বেকার সমস্যা এবং অনুঢ়া সমস্যা দুটোই কো-রিলেটেড?
তাই নাকি?
ন্যাকামো কোরো না অভিজিৎ। বুদ্ধিমান ছেলেদের এটা জানার কথা যে, দেশে এত বেকার না থাকলে মেয়েদের বরের অভাব হত না।
তা বটে।
তুমি কি জানো, উপযুক্ত পাত্রদের সংখ্যা কম বলেই দেশে একটা দুষ্ট পণপ্রথা ক্রমেই প্রসারলাভ করছে? এবং বেকার সমস্যা, বিয়ে ও পণপ্রথা এই তিনটেই পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত? জানো?
বোধহয়।
তা হলে?
তা হলে কী?
এখন চাকরি পাওয়ার পর তোমার কর্তব্য কী হওয়া উচিত?
আমি বোকার মতো চেয়ে থাকি। লোকটা বাস্তবিকই পাজির পা-ঝাড়া। তবু একে আমি ঘেন্না করতে পারছি না, এর ওপর রেগে উঠতে পারছি না। হঠাৎ হেসে ফেলে বললাম, কিছু কর্তব্য করতে হবে নাকি কারও প্রতি?
দায়িত্বশীলদের তো সেটাই মোটো হওয়া উচিত। তুমি নিজে উঠে গেছ, এবার আর একজনকেও টেনে তোলো।
কী করতে হবে?
ভেবে দেখো। আমি ফোর্স করতে চাই না।
ফোর্স করলেও লাভ নেই। কেউ ফোর্স করে কখনও আমাকে দিয়ে কিছু করাতে পারেনি।
পারিজাত একটা শ্বাস ছেড়ে বলে, মডার্ন ওয়ারফেয়ার সম্পর্কে তোমার কোনও ধারণা নেই বলে ওকথা বলছ। এ যুগে বুদ্ধিমান লোকেরা ফোর্স কীভাবে অ্যাপ্লাই করে জানো?
খানিকটা জানি!
কিছুই জানো না। তোমাকে কখনও সেই যুদ্ধে নামতে হয়নি।
আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?
দেখাচ্ছি। কিন্তু লক্ষ করছি, তুমি ভয় পাচ্ছ না।
আমি হেসে ফেলি, বলি, না, পাচ্ছি না।
তা হলে আমাকে স্ট্র্যাটেজি বদলাতে হয়।
কীরকম?
একবার প্রতিমার সঙ্গে দেখা করে অন্তত একটা হ্যালো বলে এসো। এটুকু ওর পাওনা। বেচারা মহৎ হওয়ার জন্য চাকরি থেকে সরে দাঁড়াল অথচ সেই মহত্ত্বটুকু কেউ স্বীকার করল না। এটা নিষ্ঠুরতা অভিজিৎ।
আমি রাগ করে উঠে পড়লাম। বললাম, আর কোনও কথা নেই তো?
সে সব পরে হবে।
আমি অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে সাইকেলে উঠে ঝড়ের বেগে সেটাকে চালাতে লাগলাম। এসব কী হচ্ছে কিচ্ছু বুঝতে পারছি না আমি। ষড়যন্ত্র! প্ল্যান! ফাঁদে ফেলার চেষ্টা!
আমি মউডুবির দিকে অর্ধেক পথ গিয়েও আচমকা সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে নিই।