যথেষ্ট। আমি তো শুধু সেদ্ধ দিয়ে খাই। আজ তবু ডাল হয়েছে।
আমি গণেশকাকার কাছ থেকে ধার করে আনা সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বেশি সময় নেই।
নতুন চাকরির একটা অদ্ভুত মাদকতা আছে। নিতান্তই মাস্টারি যদিও। তবু এই প্রথম নিজেকে খানিকটা মূল্য দেওয়া যাচ্ছে। একেবারে ফালতু, পরনির্ভরশীল, শিকড়হীন তো আর নই। কিছু একটা করছি, কাজে লাগছি।
আমার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা কী তা আমি জানি। শিষ্ট আমি নই, শান্তও নই। কোনওকিছুই আমি সহজে মেনে নিইনা। শিবপ্রসাদ স্কুলে ঢুকেই আমি টের পেয়েছি, এই স্কুলে গভীর গণ্ডগোল আছে। ধীরে ধীরে সেগুলি আমাকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। তারপর জোট বাঁধা। পারিজাত জানে না, কী একখানা টাইমোমা যে শিবপ্রসাদ স্কুলে স্থাপন করেছে। এর জন্য তাকে নাস্তানাবুদ হতে হবে।
আমি যেদিন প্রথম স্কুলে জয়েন করি সেদিন কিছু লোক এসে বাইরে থেকে খুব শ্লোগান দিল। কমলা সেনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ব্যর্থ করো। অসীমা দিদিমণি গদি ছাড়ো। পারিজাতের মুণ্ডু চাই।
সবাই বারণ করা সত্ত্বেও আমি ফটকের কাছে এগিয়ে গিয়ে তাদের লক্ষ করলাম। এরা কারা তা বুঝলাম না। তবে মনে হল এরা নিশ্চয়ই জনসাধারণের প্রতিনিধি নয়। ভাড়াটে লোক হওয়াই সম্ভব।
তিনদিন বাদে স্ট্রাইক হয়ে গেল। কমলা সেনের পদত্যাগের প্রতিবাদে।
গণ্ডগোলের আঁচটা প্রথম থেকেই টের পাচ্ছি। বলতে কী, গণ্ডগোলের জায়গাই আমার প্রিয়। এই আমার স্বক্ষেত্র, এই আমার ইনসেনটিভ।
একদিন অসীমাদি ডেকে পাঠিয়েছিলেন তার ঘরে।
মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন লাগছে কাজ করতে?
ভালই।–নিস্পৃহ গলায় বললাম। আমার চাকরি হওয়ার পিছনে ওঁর একটু হাত আছে। কিন্তু তা বলে কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হওয়ারও মানে হয় না। স্কুলের হেডমাস্টার বা হেডমিসট্রেসের পদটিই একটি কায়েমি স্বার্থের সুযোগ। ভবিষ্যতে হয়তো ওঁর বিরুদ্ধে আমাকে লড়তে হবে। মনটাকে বেশি কৃতজ্ঞতার মাখন মাখিয়ে রাখলে অনেক ফ্যাচাং।
উনি অবশ্য আমার মুখভাব তেমন করে লক্ষ করলেন না। কেমন যেন অন্যমনস্ক, বিপন্ন মুখভাব। হতেই পারে। কমলা সেন নাকি খুব ভাল অ্যাডমিনস্ট্রেটর ছিলেন। তাকে হটিয়ে ইনি এসেছেন। আর এই রদবদলের মূলে আছে পারিজাত। টিচার্সরুমে বসে প্রায় সারাদিনই এসব কথা হয়। কাজেই সাবধান হওয়া ভাল। লোকে যাতে ধরে না নেয় যে, আমি অসীমা বা পারিজাতের লোক। আমি তা নইও।
অসীমা দিদিমণি আমার দিকে আনমনে চেয়ে বললেন, স্কুলে খুব গণ্ডগোল হচ্ছে, তাই না? এর মধ্যে এসে নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে!
না। গণ্ডগোল হতেই পারে।
অসীমাদি একটু চুপ করে চেয়ে থেকে বললেন, আমার ভাল লাগে না। স্কুলটা চিরকাল শান্ত ছিল। কোনও গণ্ডগোল ছিল না। এখন অদ্ভুত অদ্ভুত সব লোক এসে বিশ্রী শ্লোগান দেয়, ঢিল ছেড়ে। ছেলেমেয়েরা ভয় পায়।
আমি দোনোমোনো করে বলি, ওই লোকগুলো কারা তা আপনি জানেন?
কারা আর হবে? পাবলিক।
আমার সন্দেহ থেকে গেল। কমলা সেনের পদত্যাগ যদি অবৈধ বা অন্যায় কিছু হয়ে থাকে তবে আইন-আদালত আছে। আর পাবলিকের আন্দোলন ঠিক এরকম প্রকৃতির হয় না। বেশিরভাগ স্কুলেই এরকম কিছু অভ্যন্তরীণ গোলযোগ থাকে। তাতে বাইরে থেকে রোজ ঢিল পড়ার কারণ নেই। আন্দোলন আমি কিছু কম করিনি।
পরদিন লোকগুলো আবার এল। আমি এবার ফটক খুলে বেরিয়ে সোজা তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। জনা ত্রিশেক লোক। আমাকে মুখোমুখি দেখে কেমন একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।
আমি তাদের চ্যালেঞ্জ করতে যাইনি। তবে হাতজোড় করে বললাম, আমাকে কিছু বলতে দিন।
লোকগুলো সম্মতি বা অসম্মতি কিছুই প্রকাশ করল না। আমি স্কুলের সামনে একটা কালভার্টের ওপর দাঁড়িয়ে স্ট্রিট কর্ণার করা অভ্যস্ত গলায় আধঘণ্টা ধরে একটা চোস্ত ভাষণ দিলাম। তার মধ্যে প্রচ্ছন্ন হুমকি ছিল। পুলিশ লেলিয়ে দেওয়ার ইঙ্গিতও ছিল।
কাজ হল। দুদিন যাবত তারা আসছে না।
টিচার্স রুমে যারা একদম পাত্তা দিত না তারা এখন কথাটথা বলছে।
স্কুলটা আমার ভালই লাগছে। বেশ বড় স্কুল। হাজার খানেকেরও বেশি ছাত্রছাত্রী, ডিসিপ্লিন চমৎকার। ক্লাস বাগে আনতে বাড়তি পরিশ্রম করতে হয় না।
আজ স্কুল শুরু হওয়ার মুখেই অসীমাদি ডেকে পাঠালেন।
পারিজাত আপনাকে একটু ডেকে পাঠিয়েছে। জরুরি দরকার।
আমাকে!–আমি একটু ভ্রু কোচকাই। ব্যাপারটা আমার ভাল লাগল না।
সেক্রেটারির বাড়িতে গেলে এখন ঘটনাটা অন্যরকম দেখাবে। কিন্তু ডাকলে যেতেই হয়। বললাম, কখন?
আজই। খুব দরকার বলছিল।
অগত্যা।
পারিজাত আজও জরুরি মিটিং করছিল। সুতরাং আমাকে উমেদারের মতোই অপেক্ষা করতে হল বাইরে। আমি আগের দিনের মতোই একটা কুঞ্জবনে গিয়ে ঢুকে পড়লাম। আজ অবশ্য রুমা নেই। একা আমি।
একটু বাদেই দারোয়ান এসে ডেকে নিয়ে গেল।
পারিজাত একটু ভোম হয়ে আছে। খুব মানসিক ব্যস্ততার মধ্যে থাকলে মানুষের মুখেচোখে যেন একটা আস্তরণ পড়ে যায়। তবে আমাকে দেখে ছুরির ফলার মতো ঝিকিয়ে উঠল তার হাসি, এই যে হিরো, এসো, এসো। বোসো।
আমি বসতে বসতে বললাম, হিরো কীসের?
শুনলাম, অধরের ভাড়াটে লোকজনকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছ! সত্যি নাকি?
কার ভাড়াটে লোক?
একজন নমস্য ব্যক্তির। অধর বিশ্বাস।
আমার ভিতরে একটু টিকটিক আওয়াজ হল। অধর বিশ্বাস। সেই সাইক্লিস্ট! মস্তান!