আমি বললাম, সব ঠিক হয়ে যাবে।
অসীমাও তা জানে। তাই জবাব দিল না। অনেকক্ষণ বাদে শুধু বলল, স্কুলে আমি খুব আনপপুলার হয়ে গেছি।
কেন, ছাত্রছাত্রীরাও কি তোমাকে অপছন্দ করে?
তাই তো মনে হয়।
কেউ ওদের উসকে দিচ্ছে না তো?
কী করে বলব?
খোঁজ নাও। যদি দেখো দিচ্ছে তাহলে আমাকে জানিয়ো।
অসীমা খুব করুণ বোবা এক দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইল। সে দৃষ্টির ভাষা আমি পড়তে পারলাম না। তবু মনে হল, অসীমার চোখ আমাকে বলছে, ক্ষ্যামা দাও, আর আমার ভাল তোমাকে করতে হবে না।
ছাত্রছাত্রীদের কাছে অসীমা কেন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে তা আমি বলতে পারব না। তবে সে কোনওকালেই ওদের তেমন প্রিয় দিদিমণি ছিল না। সবাই তাকে ভয় করত এবং মেনে চলত, এই যা।
আকাশ মেঘলা করেছে। কুঞ্জবন আঁধার হয়ে এল। আমি ঘড়িটা দেখে নিয়ে বললাম, চলো, উঠি।
চলো।
এইভাবেই রোজ আমাদের প্রেমপর্ব শেষ হয়। আমরা উঠে পড়ি এবং যে যার কাজে চলে যাই। অসীমা সম্ভবত এইরকম উত্তাপহীন প্রেমই পছন্দ করে। সে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করছে। ফলে তার একটা কঠোর নীতিবোধ জন্ম নিয়েছে। তাকে স্পর্শ করলে বা আরও ঘনিষ্ঠ কিছু করতে গেলে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করবে। আমি জানি বিয়ের পরেও এই সংকোচ কাটাতে তার সময় নেবে। আমারও তাড়া নেই। অসীমাই তো আমার জীবনে প্রথম মহিলা নয়। এমনকী সে আমার প্রথম স্ত্রীও হবে না।
এর আগে আমি আর একবার বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমার সেই স্ত্রী মণিমালা আত্মহত্যা করে।
২. অভিজিৎ
২। অভিজিৎ
বেশিদিন বেঁচে থাকলে মানুষকে ভারী একা হয়ে যেতে হয়। সমান বয়সের মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। আর যদিবা খুঁজে পাওয়া যায় তো যোগাযোগ হয় না।
আমার দাদুকে দেখে সেইটে খুব স্পষ্টভাবে বুঝলাম আমি।
আমার ঠাকুমা অবশ্য দীর্ঘদিন বেঁচে দাদুকে সঙ্গ দিয়ে গেছেন। তবু শেষ অবধি বয়সের কমপিটিশনে তিনি পেরে ওঠেননি। বছর পাঁচ-ছয় আগে আশি বছর পার হওয়ার বেশ কিছুদিন পর তাঁর মৃত্যু হয়। দাদু নব্বই পেরিয়েছেন। খুব বহাল তবিয়তে আছেন বলা যায় না কিন্তু আছেন।
আমাদের বাড়িটা খুবই খাঁ খাঁ করে আজকাল! বাসযোগ্য দুখানা ঘর আছে। পাকা ভিত, ইটের দেওয়াল, ওপরে টিনের চাল। আর উঠোনের দুদিকে আর-দুটো মাটির ঘর। ঠিকমতো লেপা পোঁছা এবং মেরামতি না হলে মাটির ঘর টিকিয়ে রাখা যায় না। এখানে-সেখানে খোঁদল দেখা দেয়, মেঝেয় বড় বড় গর্ত হতে থাকে, রোদে জলে ক্রমাগত সংকোচন-প্রসারণের ফলে ফাটল ধরে। আমাদের মেটে ঘর দুখানার দুর্দশা চোখে দেখলে কষ্ট হয়। ওরই একখানা ঘরে আমি চব্বিশ বছর আগে ভূমিষ্ঠ হই।
পাকা ঘর দুখানা নিয়ে দাদুর বাস। যত রাজ্যের বাজে জিনিসে ঘরদুটো ঠাসা। পুরনো কৌটো, শিশি, খবরের কাগজ, ভাঙা একখানা সাইকেল, কিছু ঘুণে ধরা তক্তা, অকাজের বাঁশের খুঁটি। দাদু কিছুই ফেলে দেননি। বরাবরই তার সঞ্চয়ের দিকে ঝোঁক। তবু সঞ্চয়ের মতো বাড়তি কিছুই তিনি হাতের কাছে পাননি কোনওদিন। যা পেরেছেন রেখেছেন। বাড়িতে মোট এগারোটা নারকোল গাছে সারা বছর অফুরন্ত ফলন। কে খাবে? দাদু নারকোল বেচে দেন। বাঁধা লোক আছে। সে এসে নারকোল ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। ছোবড়াগুলো দাদু বস্তা-বোঝাই করে সঞ্চয়ের ঘরে তুলে রাখেন। তার খুব ইচ্ছে রেলে বোঝাই করে আমরা ছোবড়াগুলো কলকাতায় নিয়ে যাই। নারকেলের ছোবড়া নিশ্চয়ই গৃহস্থের কোনও-না-কোনও কাজে লাগে। এ বাড়িতেই একসময়ে ছোবড়ার কত কদর ছিল। গোয়ালে সাঁজাল দেওয়া হত, সন্ধেবেলায় ধূপ জ্বালানো হত, দড়িদড়াও তৈরি হয়েছে একসময়ে। ওই একই মানসিকতার দরুন দাদু গত ত্রিশ বছর ধরে তার যাবতীয় পুরনো জুতো জমিয়ে রেখেছেন। অব্যবহার্য রকমের ঘেঁড়া, বেঁকে যাওয়া সেইসব জুতো কোনওদিনই কারও কাজে আসবে না। তবু আছে।
স্মৃতি তার সঙ্গে বড় লুকোচুরি খেলে আজকাল। সেও এই বয়সেরই গুণে। আর যেটা হয়, কেমন যেন আপনজনদের প্রতি ঠিক আগেকার মতো বুকছেঁড়া টান ভালবাসা থাকে না। বয়সের ইঁদুর এসে মায়ামোহের সুতোগুলো কুটকুট করে কেটে দিয়ে যায়। গাঁয়ের বাড়িতে দাদু এখন একা। নির্ভেজাল একা। তবু তার কোনও হাহাকার নেই। ছেলেমেয়ে বা নাতি-নাতনিদের কেউ এলে খুব যে খুশি হন তা নয়। এলে আসুক। গেলে যাক।
এক মাঝবয়সি মেয়েছেলে আসে রোজ। ঝটপাট দেয়। বিছানা তোলে, পেচ্ছাপের কৌটো ধুয়ে দেয়। সে-ই রান্না করে দিয়ে যায় একবেলা। দুপুরে তার যুবতী মেয়ে এসে বাসন মাজে। সন্ধেবেলা দাদু নিজেই উঠোনে কাঠকুটো জ্বেলে দুধ গরম করে নেন। খই দুধ খেয়ে শুয়ে থাকেন। বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছেন এইভাবে।
নকশাল আন্দোলনের সময় আমাকে একবার পালিয়ে আসতে হয়েছিল দাদুর কাছে। তখন থেকেই আমি তাঁর জীবনযাপনের ধারাটা ভাল করে জানতে থাকি।
সেবার আমাকে দাদুর কাছে বেশ কিছুদিন থাকতে হয়েছিল। ঠাকুমা তখনও বেঁচে ছিলেন। অনেকদিন আমি কলকাতায় ফিরছি না দেখে দাদু আমাকে নানারকম প্রশ্ন করতেন। আমি পরীক্ষায় ফেল করিনি তো? কোনও মেয়ের সঙ্গে লটঘট করে আসিনি তো? ঠাকুমা ধমক দিতেন, নাতিটা এসেছে, অত খতেন কীসের?
আমি দাদুকে আন্দোলনের সোজা কথাটা বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। কেন আন্দোলনটা হচ্ছে বা কেন হওয়া দরকার। দাদু সেসব বোঝেননি। আসলে সমাজ বা রাষ্ট্রজীবনের সঙ্গে তিনি আর ওতপ্রোত জড়িত নন। কোথায় একটা পার্থক্য ঘটেই গেছে। যেন জেটির থেকে তফাত হওয়া স্টিমার। দেশ কাল আত্মীয়তা সময় সবই এক অস্পষ্টতায় মাখা।