আমি তো আছি।
অসীমা ওপর নীচে মাথা নেড়ে চিন্তিতভাবে বলল, হ্যাঁ, তুমি আছ। সেটা অবশ্য ঠিক।
কিন্তু আমি আছি জেনেও অসীমার চোখ মুখ বিন্দুমাত্র উজ্জ্বল হল না। একটুও আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল না সে। আজ যেন ও সেই বাড়ি, যার বাথরুমের আলোটাও নিভে গেছে। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার।
আমার অসীমাকে একবার বলতে ইচ্ছে হল, বিপদের ভয় তোমার কতটুকু অসীমা? স্কুলে পোস্টার দেখোনি? পারিজাতের মুন্ডু চাই! কই একবারও আমার বিপদের কথা বললে না তো!
একটা নির্জন উপত্যকায় দুজন অশ্বারোহী বিপরীত দিক থেকে এগিয়ে আসছে। দেখা হবে। আমার ক্যালকুলেটর বলছে, লগ্ন আসন্ন। আর বড় একটা দেরি নেই।
অসীমাকে আমি ফটক পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম।
ফিরে এসে অনেকক্ষণ অন্ধকার কুঞ্জবনে বসে রইলাম চুপ করে। কুঞ্জে কোনও রাধা আসবে না। চিরকাল অপেক্ষা করলেও না। তার বদলে ঝাক বেঁধে এল মশা। কিন্তু আজ তাদের হুল আমি তেমন টের পেলাম না।
৮. অভিজিৎ
৮। অভিজিৎ
বুড়ো মানুষদের সঙ্গে থাকার একটা দোষ হল, কখন তাদের কী হয় তা নিয়ে ভাবনা থাকে।
সকালবেলায় দেখি, দাদুর মশারি গোটানো। কেমন কেতরে শুয়ে আছে। মাথাটা পড়ে গেছে। বালিশ থেকে। মুখটা হাঁ-করা। একটা মাছিও ভনভন করছে মুখের সামনে।
পরিষ্কার ডেথ-সিন। সকালে ঘুম থেকে উঠেছেন। স্ট্রোক। মৃত্যু।
পরের দৃশ্যগুলো পরপর ভেসে যাচ্ছিল চোখের সামনে। লোক ডাকো। কাঁদো, যদি সম্ভব হয়। কাধ দাও, পোড়াও।
ডাকলাম, দাদু! দাদু!
পট করে চোখ মেললেন, কী ব্যাপার?
শুয়ে আছেন যে বেলা অবধি?
ও–বলে উঠে বসলেন। কোমরের আলগা কষিটা ঠিক করতে করতে বললেন, আজকাল এটা হয়েছে। মাঝে মাঝে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়ি। রাতে ভাল ঘুম হয় না তো! কাজের মেয়েটা আসেনি?
না।
তা হলে আজ হরিমটর। রাঁধবে কে?
আমার বুকটা এখনও ধুক ধুক করছে। বললাম, দরকার হলে আমি রাঁধব। চিন্তার কিছু নেই।
তুমি রাঁধবে? তুমি রাঁধবে কেন? ইস্কুলের দেরি হয়ে যাবে না?
না। স্কুল এগারোটায় বসে।
দাদু প্রগাঢ় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, কাল অনেক রাত অবধি আমার ঘুম হয়নি। তোমার নতুন কেনা হ্যারিকেনটায় খুব আলো হয়। চোখে লাগছিল। অভ্যেস নেই কিনা, অত আলো সহ্য হয় না।
বললেন না কেন, নিবিয়ে দিতাম।
তা কেন, পড়াশুনো করছিলে বোধহয়। নতুন চাকরি, তার ওপর মাস্টারি, একটু ঝালিয়ে নেওয়া দরকারও। তাই কিছু বলিনি।
আমি বললাম, দু ঘরের মাঝখানের দরজাটায় কপাট নেই। থাকলে লাগিয়ে দিতাম।
কপাট দুটো ঘুণে ধরে পচে গেল। আমি আর লাগাইনি। কী দরকার? ও ঘরটায় তো কেউ থাকে না।
এখন আমি থাকব। কপাট আমিই লাগিয়ে নেবখন।
দাদু মাথা নেড়ে বলেন, তারও দরকার নেই। তুমি থাকবে, আমিই হয়তো থাকব না। কপাট দিয়ে তখন কী করবে?
কথাটা ভেবে দেখার মতো। আমি আর কী বলব?
দাদু বললেন, সাইকেলও তত বোধহয় একটা নো দরকার। গণেশেরটা বোধহয় আর বেশিদিন দেবে না, না?
চাইলে দেবে, কিন্তু তার দরকার কী? কিনেই ফেলব একটা।
নতুন চাকরি। টাকা পয়সা হাতে আসতে না আসতেই মোটা খরচ। সামলাতে পারবে?
হয়ে যাবে কোনওরকম।
মা-বাবাকেও কিছু পাঠাতে হবে তো।
ও নিয়ে ভাববেন না।বলে আমি রান্নাবান্নার জন্য রওনা হচ্ছিলাম।
দাদু বললেন, এক কাজ করো। আমার তেমন খিদে নেই। আজ বোধহয় একাদশীও। ছোট পঞ্জিকাটা দেখো তো।
আমি দেখলাম। একাদশীই।
দাদু বললেন, তা হলে এ বেলা গণেশের বাড়িতেই খেয়ে স্কুলে রওনা হয়ে যাও। প্রথম প্রথম পাচুয়াল হওয়া ভাল। দেরি হলে কে কী বলবে।
রোজ ওদের বাসায় যাচ্ছি।
আদর করেই তো খাওয়ায়।
তা অবশ্য করে। তবু রোজ খাওয়া ভাল নয়।
রোজ না হয় নাই খেলে, আজকের দিনটা চালিয়ে দাও। কাল কাজের মেয়েটাও এসে যাবে।
আমি বিরক্ত হয়ে বলি, মেয়েটা কি এমনি কামাই মাঝে মাঝে করে?
করে। তা আমার অসুবিধে হয় না। চালিয়ে নিই। অসুবিধে তোমাদের।
তাই দেখছি।
যতটা বীরত্বের সঙ্গে রান্না করতে রাজি হয়েছিলাম, কাঠের উনুন ধরাতে গিয়ে তা ফানটুস হয়ে গেল। স্টোভ এ বাড়িতে নেই, দাদু তা কিনবেনও না। বাড়িতে শুকনো ডালপালা, পাতানাতার অভাব নেই। এসব ইন্ধন থাকতে পয়সা দিয়ে জ্বালানি কেনে কোন আহাম্মক!
মোটামুটি একটা ডাল ভাত নামাতেই আমার দম বেরিয়ে গেল, স্কুলেরও বেলা প্রায় যায় যায়।
দাদু দূর থেকে সবই লক্ষ করছেন। আমি খেতে বসার পর বললেন, আজ পারলে বটে, কিন্তু রোজ পারবে না। কাজের মেয়েটা আজকাল ঘরের কাজ করতে চায় না। ঠিকাদারের মজুর খাটলে অনেক বেশি পায়। কাজের লোকের খুব অভাব।
আমি গোগ্রাসে গিলতে গিলতে বললাম, কোনও সমাজতান্ত্রিক দেশে ঝি চাকর বলে কেউ থাকে না। উন্নত দেশগুলিতেও নেই।
তাই নাকি?–দাদু চিন্তিতভাবে বললেন।
আমি বললাম, ভাববেন না। দুদিনে এসব অভ্যাস হয়ে যাবে। কাল আমি একটা স্টোভ কিনে আনব।
স্টোভ!-দাদু চোখ কপালে তুললেন, আবার স্টোভ কেন?
ভয় পাবেন না। রোজ জ্বালাব না, যেদিন কাজের মেয়ে আসবে না, শুধু সেদিন।
খুব খরচের হাত তোমার। এটা ভাল নয়।
যা দরকার তা তো কিনতেই হবে।
তা বলে একসঙ্গে এত! এই তো হ্যারিকেন কিনলে, সাইকেলও কিনবে বলছ, আবার স্টোভ!
খাওয়া শেষ করে উঠতে উঠতে বললাম, আপনার আজ খেতে কষ্ট হবে। শুধু ডাল ভাত আর সেদ্ধ।