আমি অনুচ্চ স্বগতোক্তির মতো বলি, স্কুল ছাড়া আপনি আর কোনও কিছুর কথাই ভাবেননি বহু বছর ধরে। শুধু স্কুল আর স্কুল। স্কুলটাই সর্বস্ব ছিল আপনার। আমি আপনার সেই সর্বষই কি কেড়ে নিচ্ছি।
কমলার ঘাড় নোয়ানো, ঘড়ির স্ট্র্যাপ নিয়ে খেলা করতে করতে মৃদু একটু হাসলেন। জবাব দিলেন না।
আমি বললাম, এবার অন্য দিকগুলোয় মন দিতে পারবেন।
কমলা আমার দিকে একটু তাকালেন, পট করে চোখ নামিয়ে নিয়ে বললেন, ঠিক জানেন, পারব?
পারবেন না?
কমলা একটু চুপ করে থাকলেন। তারপর খুব ধীর স্বরে বললেন, কী জানি! মনে হয় না। আমার সবদিকই হারিয়ে গেছে।
বহুদিন। আমি বহুদিন ধরে লক্ষ করছি এক অসম লড়াই। একদিকে স্কুল, অন্যদিকে অধর। একজন বিবাহিত প্রায়-মধ্যবয়স্ক পুরুষ, যে আর সাইকেলের জাদু দেখায় না, কিংবা দেখালেও তাতে আর কিছু যায় আসে না। অন্যদিকে একটা বিশাল স্কুল, যা গড়ে উঠছে, গড়ে তুলছে। প্রাণবন্ত, স্পন্দনশীল। অধরের কিছু দেওয়ার নেই আর। কিন্তু স্কুল অসংখ্য কচি হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরছে কমলাকে। ব্যগ্র, আকুল হাত। অধর পারবে কেন? কমলার মনের মধ্যে কবেই তো মরে গেছে সে। তবু তার একটা প্রেতচ্ছায়া আছে। সেটাকেই সে বলে ভুল হয় বারবার। আমি জানতাম।
কমলা নতমুখে হাসলেন। কেন হাসছেন? এ তো হাসির সময় নয়!
কমলা আচমকা মুখ তুললেন। স্পষ্ট ও সহজ ভঙ্গিতে তাকালেন আমার দিকে। মুখে এখনও স্মিত ভাব। বললেন, স্কুলের হিসেবে অনেক কারচুপি ধরা পড়েছে।
আমি মাথা নাড়লাম, জানি।
কমলা আমার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন। আস্তে আস্তে বললেন, স্কুলের মেন্টেনেন্সের জন্য আমরা কনট্রাক্ট দিয়েছিলাম অধর বিশ্বাসকে। বহু টাকার কনট্রাক্ট। স্কুলের নতুন দুটো উইং তারই তৈরি। তাকে যেসব পেমেন্ট দেওয়া হয়েছিল তার অনেকগুলো ভাউচার নেই। আপনি কখনও আমাকে প্রশ্ন করেননি, ভাউচারগুলো কী হল।
আমি মৃদু হেসে বললাম, না। কারণ আমি জানতাম সেগুলো আপনি সরিয়ে নিয়েছেন। হয়তো অধর আপনাকে সরাতে বলেছে।
হ্যাঁ। মানুষকে যখন নিশিতে পায় তখন সে অনেক অস্বাভাবিক কাণ্ড করে। আপনার কাছে কি ক্ষমা চাইতে হবে?
আমি মাথা নেড়ে বলি, না। কারণ আমার কাছে প্রত্যেকটা ভাউচারের ফটোকপি আছে। আমি বিপদে পড়তে ভালবাসি না।
স্নিগ্ধ এক দৃষ্টিতে আমাকে অকপটে কমলা নিরীক্ষণ করছিলেন। মুখে দুষ্টুমির একটু হাসি মেখে নিয়ে বললেন, আমিও জানতাম, আপনাকে বিপদে ফেলা সহজ নয়। আর সেই ভরসাতেই চুরি করেছিলাম।
আমার ভিতরকার সেই আশ্চর্য ক্যালকুলেটরটির কথা ওঁকে বললাম না। সর্বদাই সে হিসেব কষে, সর্বদাই সে টের পায়, সর্বদাই সে দেয় নির্ভুল বিপদসংকেত। কিন্তু সেটা কোনও বড় ব্যাপার নয়। স্কুলের কাগজপত্রে যে অদৃশ্য হাত পড়ছে তা অনেক আগেই অসীমা মারফত আমি জানতে পারি। ঘটনাটা আমার ভিতরকার ক্যালকুলেটরকে জানাই এবং প্রশ্ন করি, হাতটা কার হতে পারে বলল তো! ক্যালকুলেটর অল্প সময়েই তথ্য বিশ্লেষণ করে জানিয়ে দিয়েছিল, হাতটা কমলা সেনের। কিন্তু মুশকিল হল, কমলা সেনকে আমি জানি। এই কঠোর প্রশাসন ও নীতিপরায়ণ মহিলার পক্ষে এ কাজ করা প্রায় অসম্ভব। তবে ওঁর একটি রন্ধ্র আছে। সেই রন্ধ্র দিয়েই লোহার বাসরে মাঝে মাঝে হানা দেয় কালনাগিনী। অধর। পুরো একটা দিন আমি ক্যালকুলেটরে অনেক হিসেব-নিকেশ করি। বারবার প্রশ্ন করতে থাকি ক্যালকুলেটরকে, কী করব? কমলাকে হাতেনাতে ধরব, না কি একটা বিকট গণ্ডগোল পাকিয়ে বসব?
না, আমি ওসব করিনি। বরাবর আমার যুদ্ধ ছিল অন্যরকম। অনেক আধুনিক ও বৈপ্লবিক সেই যুদ্ধাস্ত্র। আমি জানতাম, কমলা সেন নিজের দ্বারা চালিত হয়ে এ কাজ করছেন না। এ কাজ তাকে দিয়ে করাচ্ছে একটা ভূত। একটা প্রেতচ্ছায়া। একটা মৃত প্রেমের স্মৃতি। একদিন কমলা সেন জেগে উঠবেনই। একদিন সচকিত হয়ে তিনি আত্মধিক্কারে বলে উঠবেন, ছিঃ ছিঃ! এবং সেই মুহূর্ত থেকেই তিনি অধরকে ঘৃণা করতে শুরু করবেন। এর চেয়ে বড় কাউন্টার-অ্যাটাক আর কী হতে পারে আমার পক্ষে?
তাই আমি শুধু নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য কাগজপত্রগুলির ফোটোকপি গোপনে তৈরি করে রেখেছিলাম মাত্র। মুখে কিছুই বলিনি। আজ কমলা সেনের মুখ দেখে বুঝতে আর কষ্ট নেই তার কৈশোর থেকে বহন করে আনা প্রেমের শবদেহটিতে পচন শুরু হয়েছে। তিনি তা কাধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন। স্নান করেছেন। শুদ্ধও হননি কি?
আমার দিকে চেয়ে থাকা কমলা সেনের শেষ হচ্ছে না যেন। চেয়ে থেকেই বললেন, কেউ কথাটা জানবে না, না?
না। জানার দরকার নেই।
কিন্তু লোকে চিরকাল আপনাকে অপবাদ দেবে, এমন একজন ভাল হেডমিসট্রেসকে স্কুল ছাড়তে বাধ্য করেছেন বলে।
মৃদু হেসে বলি, দিক। লোকে আমার আরও অনেক গুরুতর অন্যায়ের কথা জানে। আমার তাতে কিছু যায় আসে না।
কমলা সেন মুখ টিপে হেসে বললেন, অথচ পাবলিকের কাছে আমাকে কত ছোট করে দিতে পারতেন আপনি। করলে আর কেউ আপনাকে দায়ী করত না।
আপনি ছোট নন।
কমলা সেন আবার হাসলেন। ভারী শিশুর মতো হাসছেন আজ। শিশুর মতোই সরলভাবে চেয়ে থাকছেন। মৃদুস্বরে বললেন, তাই বুঝি?
আমি একটু আনমনা হয়ে যাই। আমার অস্ত্র শুধু কমলাকে আঘাত করেই যে ক্ষান্ত হয়েছে এমন নয়। অস্ত্রটি হয়তো এখনও ক্রিয়াশীল এবং হয়তো একদিন তা আমাকে লক্ষ্য করেই ছুটে আসবে। অধর যেমন কমলাকে কাজে লাগিয়েছিল, তেমনি কাউন্টার-অ্যাটাকে আমার দাবার ঘুটি ছিল অসীমা। জাগ্রতবিবেক কমলা যেমন করে ঘৃণা করছেন অধরকে, তেমনি একদিন অসীমাও কি করবে না আমাকে?