আমি হেসে বললাম, গ্র্যাজুয়েট হতে একটু এলেম লাগে।
আপনার সেটা নেই?
না। আমার মাথাটা চিরকালই একটু মোটা।
মেয়েটা খুশিয়াল একটা খিকখিক হাসি হেসে বলল, আমারও তো মাথা মোটা। লেখাপড়া আমারও বেশিদূর হয়নি।
আমি উদাস গলায় বললাম, আপনাদের তো দরকার করে না। টাকা আছে।
মেয়েটা বড় বড় চোখে অবাক ভাব ফুটিয়ে বলে, কে বলল দরকার করে না? লেখাপড়া না শিখলে ভাল বর জোটে না তা জানেন?
আমি নিশ্চিন্তির গলায় বললাম, আপনার মতো সুন্দর মেয়েদের আবার বরের ভাবনা!
ও বাব্বা! কমপ্লিমেন্ট দিতেও জানেন দেখছি! খুব বোকা তো নন।
ঠিক বোকা নয়, তবে গেঁয়ো বটি। রাগ করলেন না তো!
ওমা! প্রশংসার কথায় রাগ করব কেন?
আমি উদাস গলায় বলি, আজকাল ভাল কথাতেও অনেক মেয়ে চটে যায়। গেলবার শীতকালে একবার বাসে বাসেরগঞ্জে যাচ্ছিলাম। একটা সুন্দরমতো মেয়ে দেখি হাতকাটা ব্লাউজ পরে জানলার ধারে বসা। বেশ ঠান্ডা হাওয়াও মারছিল সেদিন। অনেকক্ষণ দেখে থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম, দিদি, আপনার শীত করছে না? ও বাবা, এমন রেগে গেল এই মারে কি সেই মারে!
বানিয়ে বলা। মেয়েটা তবু ক্ষীণ একটু হাসল। বলল, ছেলেদেরও অনেক দোষ আছে। মেয়েদের চোখে পড়ার জন্য তারা অনেক বোকা-বোকা কাণ্ড করে।
ইঙ্গিতটা আমার প্রতিই কি না তা বুঝতে না পেরে আমি সরলভাবেই জিজ্ঞেস করলাম, আজ্ঞে, কথাটা আমাকে মনে করেই বলছেন না তো!
মেয়েটা আমাকে একবার তেরছা চোখে দেখে নিয়ে বলে, আপনি একটু গায়ে পড়া বটে, কিন্তু এখনও তেমন কিছু কাণ্ড করেননি। আমি আর একটা ছেলের কথা জানি। প্রফেসর। লেখাপড়া নিয়ে দিব্যি ছিল। হঠাৎ একটা মেয়েকে খুশি করতে ব্যায়াম শুরু করল। তাতে তার গায়ে ইয়া ইয়া গুলি ফুটে উঠল বটে, কিন্তু মাথাটা গেল মোটা হয়ে। মেয়েটাও পালোয়ান প্রফেসরকে তেমন পছন্দ করতে পারছিল না। তারপর সে কী করল জানেন? গান আর নাচ শিখতে লাগল।
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, বলেন কী? একটা মেয়ের জন্য এত মেহনত? লোকটা মাইরি আমার চেয়েও বোকা আছে। কে বলুন তো?
মেয়েটা মাথা নেড়ে মুখ টিপে হেসে বললে, সব ছেলেই ওইরকম। কিছু কম আর বেশি।
আমি বড় একটা শ্বাস ছেড়ে বললাম, আমার অত মেহনত কিছুতেই পোষাত না।
মেয়েটা একটু উষ্মার সঙ্গে বলল, কেন? মেয়েরা কি ফেলনা যে তাদের খুশি করার জন্য কিছু করতে নেই পুরুষদের!
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ঠিক তা বলিনি। তবে যার কথা বললেন সে আদত পুরুষই তো নয়। একটা মেয়ে ডুগডুগি বাজাচ্ছে, আর লোকটা বাঁদরের মতো নেচে যাচ্ছে।
মেয়েটা এবার আর একটু রেগে গেল যেন। ঝামরে উঠে বলল, বেশ করছেনাচছে। ভালবাসার জন্য সবকিছু করা যায়।
আমি বললাম, এই যে বললেন বোকা-বোকা কাণ্ড!
মেয়েটা তেজের সঙ্গে বলে, মোটেই বোকা-বোকা কাণ্ড নয়। লোকটা সত্যিকারের পুরুষ বলেই পেরেছে। সে অলস নয়, অকর্মা নয়, অক্ষম নয়। একজন মেয়ের প্রেমে তার সুপ্ত সব প্রতিভা জেগে উঠেছে।
এবার আমি হাঁ করে রইলাম। গোলমালটা ঠিক ধরতে পারছিলাম না। আবছা মনে হচ্ছিল, সেই বোকা লোকটার নায়িকা বোধহয় এ মেয়েটা নিজেই। তাই চট করে স্ট্র্যাটেজি পালটে নিয়ে বললাম, অবশ্য আপনার মতো একজন মেয়ের জন্য অনেক কিছু করা যায়। ব্যায়াম, নাচ, গান, সব কিছু
মেয়েটা আমার কথা শুনল বলে মনে হয় না। কেমন কুটিকুটিল এবং চিন্তান্বিত মুখে সামনের দিকে চেয়ে আছে। বেশ কিছুটা সময় চেয়ে থেকে বলে, কিন্তু মুশকিল হয়েছে, কিছু পেতন আর শাঁকচুন্নি সেই ছেলেটার পিছনে লেগেছে। কেন যে মেয়েগুলো এমন হ্যাংলা।
বলেই মেয়েটা একটু সচকিতভাবে আমার দিকে চেয়ে একটু হেসে কথাটা চাপা দেওয়ার জন্য বলল, কিছু মেয়ে এরকম থাকেই। তাই না? তবে জেনারেলি ছেলেরাই হ্যাংলামো বেশি করে। পেতনি আর শাকচুনিগুলোকে কী করা যায় বলুন তো!
আমি একগাল হেসে বললাম, ঝাটাপেটা করুন। কষে ঝাটা মারুন।
মেয়েটা বড় বড় চোখ করে আমার দিকে চেয়ে বলল, তাই মারব। খবর পেয়েছি গন্ধর্ব এক দঙ্গল মেয়ের সঙ্গে নর্থ বেঙ্গল যাচ্ছে। যাওয়াচ্ছি! এমন কুরুক্ষেত্র করব এবার।
বলতে বলতে মেয়েটা আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এক ঝটকায় উঠে ঝম করে চলে গেল।
আমি বসে বসে কিছুক্ষণ আমার বিদীর্ণ মস্তিষ্কের টুকরোগুলো জোড়া দিলাম। একটা ছক বা পড়ল। খুব একটা জটিল ছক নয়।
বসে আছি, হঠাৎ দারোয়ান এসে এত্তেলা দিল, বাবু ডাকছেন।
আমি একটু অবাক হলাম। বাবু অর্থাৎ পারিজাতের আমাকে ডাকার কথাই নয়। কারণ, আমি যে এসেছি তা সে জানে না। উপরন্তু আমি উমেদার। আমাকে এড়ানোর চেষ্টাই তার পক্ষে স্বাভাবিক।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে উঠে পড়লাম।
পারিজাত বাইরের ঘরে বসে আছে। আমাকে দেখে খুব অবাক হয়ে বলে ওঠে, আরে তুমি!
আমিও আকাশ থেকে পড়ে বললাম, কেন, আপনিই তো দারোয়ান দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠালেন!
পারিজাত হেসে ফেলল। বলল, তুমিই এতক্ষণ কমার সঙ্গে কুঞ্জবনে বসে ছিলে? কী আশ্চর্য!
এতে অবাক হওয়ার কী আছে?
পারিজাত আমার দিকে নতুন এক আবিষ্কারকের চোখে তাকিয়ে বলে, তুমি তো দেখছি মেয়েদের পটাতে ওস্তাদ। রুমা আমাকে কী বলে গেল জানো?
না। কী করে জানব?
বলে গেল, কুঞ্জবনে একটা ছেলে বসে আছে। ভারী ভাল ছেলে। একটু বোকা, কিন্তু খুব সরল। ও যে কাজের জন্য এসেছে সেটা যেন ওর হয়।