আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটি সম্পর্কে পর পর কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিই। আমার একটুও ভয় করছিল না। কারণ ভয় জিনিসটা আমার সহজে হয় না। মেয়েদের সম্পর্কেও আমার অনাবশ্যক ও বাহুল্য কোনও স্পর্শকাতরতা বা সংকোচ নেই। কেউ আমাকে অপমান করতে পারে ভেবেও আমি অস্বস্তি বোধ করি না। এক কথা, আমি বিস্তর অপমান হজম করতে পারি। দ্বিতীয়ত, পালটা অপমান করতেও আমি পিছপা নই।
মেয়েটি তাকাল, কিন্তু চমকাল না। সম্ভবত খুব গভীরভাবে কিছু ভাবছিল। সেই ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে পুরোপুরি ফিরে আসতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে গেল। তারপর আমাকে দেখল মেয়েটি এবং কিছুক্ষণ চেনার চেষ্টা করল। তারপর অত্যন্ত নিরুত্তাপ গলায় জিজ্ঞেস করল, এখানে কী চাই?
এই প্রশ্নটার জবাব তৈরি করার জন্য আমি অনেকটা সময় পেয়েছি। কিন্তু জবাবটা তৈরি হয়নি। সাদামাটা জবাব দিয়ে লাভও নেই। মেয়েটি কিছু অদ্ভুত। সাধারণ মেয়েরা এরকম পরিবেশে অচেনা কাউকে আচমকা দেখলে চমকায় এবং কে বলে চেঁচিয়ে ওঠে। এ মেয়েটা একটুও চমকায়নি বা কে বলে চেঁচায়নি। বরং অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে প্রশ্ন করেছে এখানে কী চাই। এই প্রশ্নের মধ্যেই দুটো বক্তব্য রয়েছে। এক হল, এটা তোমার জায়গা নয়। দ্বিতীয় হল, এখানে এসে তুমি অন্যায় করেছ, কেটে পড়ো।
এসব অভদ্র মেয়ের কাছে বিনীত হওয়ার কোনও মানেই হয় না। আমি পালটি দেওয়ার জন্যই কুঞ্জবনটায় ঢুকে চারধারে খুব কৌতূহলের চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে দেখতে কৃত্রিম বিস্ময়ের সঙ্গে বললাম, আরিব্বাস! দারুণ জায়গা তো! একেবারে কুঞ্জবন!
মেয়েটা নিশ্চয়ই এরকম ব্যবহার আশা করেনি। বড় বড় চোখ করে অপলকে আমাকে দেখল কিছুক্ষণ। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, এটা বাইরের লোকেদের জন্য নয়। আপনি বারান্দার বেঞ্চে গিয়ে বসুন।
আমি বোকার মতো বললাম, কেন, এখানেও তো দিব্যি বেঞ্চ আছে। এখানে বসা যায় না!
মেয়েটা যথেষ্ট রেগে যাচ্ছে। কিন্তু দুম করে কোনও বোমা ফাটল না। খুব হিসেবি চোখে আমাকে মাপজোক করল কিছুক্ষণ। তারপর ঠান্ডা গলাতেই জিজ্ঞেস করল, আপনি কি পাগল? দেখছেন তো, আমি এখানে বসে আছি।
আমি বোকা ও সরল সেজে বললাম, আপনি কি এ বাড়ির লোক?
হ্যাঁ। কেন? ভ্রূ কুঁচকে মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।
আমি ক্যাবলার মতো হেসে বললাম, ও, তাই বলুন। নইলে অত চোটপাট করবেনই বা কেন? আমি প্রথমটায় ভেবেছিলাম, আপনিও বুঝি আমার মতো কোনও কাজে এসেছেন পারিজাতবাবুর কাছে।
আমার বোকা ও সরল ভাবটা বোধহয় বিশ্বাস করল মেয়েটা। একটু ভিজলও মনে হয়। গলা এক পা নামিয়ে বলল, উনি আমার দাদা। আপনার ওপর কি আমি খুব চোটপাট করেছি?
আমি ক্যাবলা ভাবটা ধরে থেকেই ঘাড়-টাড় চুলকে বললাম, তাতে কিছু না। যেখানেই যাই সেখানেই লোকে ধমক চমক করে কথা বলে আজকাল। তাই অভ্যাস হয়ে গেছে।
আপনাকে সবাই ধমকায় বুঝি? মেয়েটা এই প্রথম ক্ষীণ একটু হাসে।
আমি হেঁ হেঁ করতে করতে বলি, আজকালকার যুগটাই পড়েছি অমনি। কারও মেজাজ ঠিক নেই।
মেয়েটা একটু সরে বসে পাশে অনেকটা জায়গা কঁকা করে দিয়ে বলল, বসুন।
আমি বসলাম।
আগের দিন মেয়েটির সিঁথিতে সিঁদুর দেখিনি। আজ বসবার সময় কাছাকাছি হতে আচমকা মনে হল, সিথিতে লালমতোকী যেন একটু দেখা গেল। সিঁদুরও হতে পারে, বা লিপস্টিক কিংবা কুমকুম জাতীয় কিছু যা আজকালকার বিবাহিতা মেয়েরা সিদুরের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে ভালবাসে।
সরল এবং বোকা সাজার কতগুলো সুবিধে আছে। মেয়েটা যদি সত্যিই বিশ্বাস করে থাকে যে, আমি নিতান্তই হাবাগোবা গোছের, তা হলে আমি যতই অনভিপ্রেত প্রশ্ন করি না কেন, চটবে না।
আমি বসে একটা ক্লান্তির শ্বাস ফেলে বললাম, আপনি কি এ বাড়িতেই থাকেন?
হ্যাঁ।
আপনার বিয়ে হয়নি?
মেয়েটা শব্দ করে হাসল। তারপর বলল, নে, হাতে পাত্র আছে নাকি?
আমি নিশ্চিন্ত হলাম। মেয়েটা চটছে না। বোকা বলেই ধরে নিয়েছে। অপ্রতিভ ভাব করে বললাম, আজ্ঞে না। কত বড় মানুষ আপনারা। বড় বড় সব পাত্র আসবে আপনাদের জন্য।
মেয়েটা চুপ করে কুঞ্জবনের আবছায়ায় আমাকে একটু দেখল। তারপর বলল, আপনাকে দেখে তো খুব বোকা মনে হয় না!
আমি জিব কেটে বললাম, কী যে বলেন! গায়ের লোক, বোকা ছাড়া আর কী?
আপনার কোন গাঁ?
মউডুবি আজ্ঞে। বেশি দূর নয়।-বলেই মনে মনে ভাবলাম, অতি অভিনয় হয়ে যাচ্ছে না তো! এত আজ্ঞে আজ্ঞে করে যারা কথা বলে তারা আমার মতো পোশাক পরে না।
দাদার কাছে আনার কীসের কাজ?
আমি মাস্টারির কথাটা চেপে গেলাম। কারণ সেটা বললে আবার লেখাপড়ার কথাটাও উঠে পড়বে। বললাম, এই ছোটখাটো যা হোক একটা কিছু কাজ পাওয়ার চেষ্টা করছি। পারিজাতবাবুর তো মেলা জানানো।
গাঁয়ের ছেলে, চাষবাস করেন না কেন?
জমিই নেই।
কী হল?
বিক্রিবাটা, জবর দখল এসব নানারকম হয়ে বেহাত হয়ে গেছে।
চলে কী করে?
চলছে না বলেই তো হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছি।
লেখাপড়া কতদূর?
ওই স্কুলটা কোনওরকম ডিঙিয়েছিলাম।
বয়স তো বেশি নয়। পড়লেই তো পারেন।
আর পড়ে কী হবে? শুধু পয়সা খরচ। পড়ে কাজও পাওয়া যায় না।
মেয়েটা আলস্যের বশে একটা হাই তুলে বলল, বেশি লেখাপড়া অবশ্য আমিও পছন্দ করি না। তবে গ্র্যাজুয়েটটা হলে চাকরির অনেক সুযোগ আসে।