আমি বললাম, কথাটা কিন্তু মিথ্যে নয়। বিবাহযোগ্য যুবকেরা এখন ওয়ার্কিং গার্লই প্রেফার করছে। এখনও ভেবে দেখুন লড়বেন কি না।
লড়ার ইচ্ছে থাকলে আর এতক্ষণ বসে আছি! বাবা বলে গেছে, আজ সকালে যেন পারিজাতবাবুর কাছে একবার যাই। উনি নাকি ডেকেছেন। কিন্তু আমি যাইনি।
গিয়ে কী হত?
তা কে জানে! পারিজাতবাবুর হয়তো কিছু জানার ছিল।
প্রতিমার জন্য আমার একটু দুশ্চিন্তা হতে লাগল। পারিজাতের বাড়িতে ওকে পাঠানোর পিছনে জহরবাবুর কোনও অদ্ভুত উদ্দেশ্য নেই তো! থাকলেও অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। প্রতিমা আমার কেউ নয়, জহরবাবুরই আত্মজা। ওর ভালমন্দ উনিই বুঝবেন। তবু মনটায় একটা খিচ থেকেই গেল। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম, পারিজাতের সঙ্গে অসীমা দিদিমণির বিয়ের কথা কি একদম পাকা?
ওমা! পাকা নয়তো কী? খুব অবাক হয়ে প্রতিমা বলে।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, বিয়েটা যতক্ষণ না ঘটছে ততক্ষণ কিছুই বলা যায় না। হয়তো কোনও কারণে বিয়েটা ভেঙে গেল।
কী কারণ?
ধরুন যদি সে কারণ আপনিই হন!
আমি?–প্রতিমা আকাশ থেকে পড়ে বলে, আমি কীসের কারণ? যা!
কথাটা হঠকারিতাবশে বলে ফেলে আমি একটু বিপদেই পড়লাম। প্রতিমা সিধে-সরল মানুষ। বোধহয় সহজেই ঘাবড়েও যায়। মুখখানা কাঁদো কাঁদো করে আমার দিকে চেয়ে রইল।
আমি সাহস করে বললাম, আপনিই বলেছিলেন পারিজাত ভাল লোক নয়, খুন করারও অভ্যাস আছে। ওর কাছে কোনও যুবতী এবং সুন্দরী মেয়ের কি একা যাওয়া ভাল?
প্রতিমার মুখের আহত ভাবটা রয়েই গেল। বলল, কিন্তু আপনি তো সে ইঙ্গিত করেননি। একটা খুব বাজে কথা বলেছেন। কেন বললেন?
আমি নির্বিকার মুখে বললাম, মনে হল, তাই বললাম।
প্রতিমা অত্যন্ত অকপটে বলল, আপনি খুব খারাপ।
আমার চেয়েও খারাপ লোক আছে।
প্রতিমা আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল। ওর চোখে টলটল করছে জল। তবু আমার মনে হচ্ছিল, কথাটা বলে আমি ওর উপকারই করেছি। সরল মেয়ে, হয়তো দুনিয়ার প্যাঁচ খেচ তেমন ভাল জানে না। যদি আমার কথায় সচেতন ও সতর্ক হয় তবে ভালই হবে।
কিছুক্ষণ বিমর্ষভাবে বাইরে চেয়ে থেকে হঠাৎ সে আমার দিকে তাকাল। বলল, আমার চাকরির আর দরকার নেই। তাই পারিজাতবাবুর কাছে যাওয়ারও প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু পারিজাতবাবুর কাছে গেলেই যে মেয়েরা বিপদে পড়ে একথা আপনাকে কে বলল? ওঁর কাছে নানা কাজে কত মেয়ে যাচ্ছে।
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, আহা, কথাটা অত সিরিয়াসলি নিচ্ছেন কেন?
কথাটা আপনি বললেন কেন তা হলে?
আর বলব না।
আপনি ভীষণ খারাপ। বলতে বলতে প্রতিমা উঠে দাঁড়াল এবং কোনও কথা না বলেই ভিতরবাড়িতে চলে গেল হঠাৎ।
কী আর করা! বেকুবের মতো মিনিটখানেক বসে থেকে আমি ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রতিমাকে একটা কথা বলে আসার সুযোগ হল না। নইলে আমি বলতাম, আমি খারাপ বটে, কিন্তু আপনি ভাল। বেশ ভাল। এরকম ভাল থাকারই চেষ্টা করবেন।
সিংহীবাড়িটা পেরোনোর সময় খোলা ফটক দিয়ে দূরে গাড়িবারান্দার কাছে একটা জিপগাড়ির মুখ দেখতে পেয়ে আমি ব্রেক কষি। পারিজাত হয়তো কোথাও গিয়েছিল, ফিরেছে। নয়তো কোথাও যাবে। আমি খুব কিছু চিন্তাভাবনা না করে সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে খোলা ফটক দিয়ে ঢুকে পড়লাম।
ভিতরে ঢুকে দেখি, একটা নয়, দুটো জিপ এবং একটা অ্যাম্বাসাডর গাড়িবারান্দার আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তিনটে গাড়িতেই ত্রিসিংহ মার্কা দেখলাম। অর্থাৎ সরকারি গাড়ি।
আজ সিঁড়ির মুখেই দারোয়ান। আমি সাইকেল গাড়িবারান্দার তলায় থামাতেই সে বলল, এখন দেখা হবে না। জরুরি মিটিং হচ্ছে।
বাইরের ঘরের দরজা আঁট করে বন্ধ। বেশ হাই লেভেলের গুরুতর সলাপরামর্শ হচ্ছে নিশ্চয়ই। আমি একটু উগ্র গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ভিতরে কে কে আছে?
দারোয়ানটা এমনিতে হয়তো আমাকে পাত্তা দিত না। কিন্তু সেদিন সে বোধহয় সকালে আমাকে পারিজাতের সঙ্গে দৌড়োত দেখেছে। আমাদের ঘনিষ্ঠতা কতটা তা আন্দাজ করা তার পক্ষে মুশকিল। একটু ইতস্তত করে সে বলল, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, আর ফুড অফিসার। আরও কয়েকজন আছে।
আমি সাইকেলটা গাড়িবারান্দার ধারে স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে বললাম, ঠিক আছে, মিটিং শেষ হোক। আমি বাগানে অপেক্ষা করছি।
দারোয়ান কিছু বলল না।
সিংহীদের বাগান বরাবর আমাকে আকর্ষণ করত। আজও করে। পারিজাতকে ধন্যবাদ যে, বাগানটায় সে হাত দেয়নি। যেমন ছিল প্রায় তেমনই রেখে দিয়েছে। অলস পায়ে আমি বাগানটায় ঘুরতে লাগলাম। সিংহীরা ককর বালি আর কী কী সব মিশিয়ে বাগানের তলায় জলনিকাশি ব্যবস্থা করেছিল। এই ভারী বর্ষাতেও তাই বাগানে তেমন জল দাঁড়ায়নি। তবু চটিজোড়া ভিজে যাচ্ছিল। হাওয়াই চটি ভিজলেই পিছল হয়ে যায়। হাঁটতে অসুবিধে বোধ করে আমি একটা কুঞ্জবনে ঢুকে বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। রোদটাও বড্ড চড়চড় করছে।
হাতের কাছে যে কুঞ্জবনটা পাওয়া গেল সেটায় ঢুকেই থমকে যাই। ভিতরের আবছায়ায় একটা মেয়ে বসে আছে। সেই মেয়েটিই, যে আমাকে সেদিন মোটেই আমল দেয়নি। কিন্তু মেয়েটি কেমন যেন গা ছেড়ে মাথা পিছনে হেলিয়ে বসে আছে। চোখদুটো বোজা। আমাকে টের পায়নি। কুঞ্জবনে ঢুকবার মুখটায় দাঁড়িয়ে আবছায়াতেই আমি মেয়েটিকে লক্ষ করি। সম্ভবত ত্রিশের কাছাকাছি বয়স। মুখে এক ধরনের লালসা ও নিষ্ঠুরতা আছে। স্বভাব যে উগ্রতা ওর মুখের হাঁটকাট দেখেই বোঝা যায়। এসব মেয়েরা শরীরকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।