প্রতিমা বড় বড় চোখে আমার দিকে চেয়ে বলে, আপনি ওকে সাপোর্ট করছেন?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ওকেও করছি না, ওর বউকেও করছি না। মনে হয় ব্যাপারটা হয়েছিল শঠে শাঠ্যং।
আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, পারিজাত খুন করতে পারে না এমন নয়। অতিশয় উচ্চাশাসম্পন্ন, অহংকারী ও যশপ্রতিষ্ঠালোভী লোকের পক্ষে কাজটা অসম্ভবও নয়। কিন্তু পারিজাতকে আমি যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হয় না যে, সে খুন-টুন করেছে। লোকটার ক্ষুরধার বুদ্ধি। এ যদি কখনও খুন করে তবে এমন সূক্ষ্ম পন্থায় করবে যাতে তার ওপর লোকের বিন্দুমাত্র সন্দেহ হবে না।
প্রতিমা অবশ্য তর্কের গলায় বলল, মোটেই শঠে শাঠ্যং নয়। পারিজাতবাবুর বউ ছিল দারুণ সুন্দরী আর খুব শিক্ষিতা।
আমি প্রতিমাকে একটু জ্বালাতন করার জন্যই বললাম, তাতে কী? সুন্দরীই তো গণ্ডগোল করে বেশি। হয়তো তার গোপন প্রেমিক ছিল।
মোটেই নয়।
খুনটা কি এখানে হয়েছিল?
না। কলকাতায়।
তা হলে এত ডিটেলস জানলেন কী করে?
শুনেছি।
শোনা কথার ফিফটি পারসেন্ট বাদ দিতে হয়।
চা নিয়ে এলেন প্রতিমার মা। ভারী রোগা-ভোগা মানুষ। পরনে মলিন একখানা শাড়ি। প্রণাম করার সময় ওঁর পায়ে হাজা লক্ষ করলাম। লাজুক মানুষ। চা দিয়ে শুধু বললেন, তোমরা বসে গল্প করো। বলেই চলে গেলেন।
চায়ে চুমুক দিয়ে বুঝলাম, প্রতিমারা বাস্তবিকই গরিব। অত্যন্ত বাজে সস্তা চা-পাতায় তৈরি কাথটি আমি প্রতিমার সুশ্রী মুখখানা দেখতে দেখতে খেয়ে নিলাম। ওই অনুপানটুকু না থাকলে চা গলা দিয়ে নামত না।
পারিজাতের বউকে ছেড়ে প্রতিমা অন্য প্রসঙ্গ তুলল, আচ্ছা, হায়ার সেকেন্ডারিতে আপনি নাকি দারুণ রেজাল্ট করেছিলেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কে বলল?
সব জানি। চারটে লেটার। আপনি কি নকশাল ছিলেন?
ও বাবা! অনেক জানেন দেখছি!
জানিই তো। লোকে বলে আপনি ডেনজারাস ছেলে ছিলেন।
আমি বললাম, ডেনজারাস জেনেও বাড়িতে ডেকে এনে চা খাওয়াচ্ছেন?
আপনাকে দেখে মোটেই ডেনজারাস মনে হয় না।
তা হলে কী মনে হয়?
বললাম তো, ডেনজারাস মনে হয় না।
সেটা তো নেতিবাচক গুণ। অস্তিবাচক কিছু বলুন।
মোটে তো আলাপ হল। কদিন দেখি, তারপর বলব।
আমি একটু হতাশার গলায় বললাম, দেখবেন কী করে? আমি তো কয়েকদিনের মধ্যেই কলকাতায় ফিরে যাব।
কেন, ফিরে যাওয়ার কী হল? চাকরি তো পাচ্ছেনই।
চাকরিটা বরং আপনিই করুন। স্কুলের চাকরির সঙ্গে পারিজাতের জীবনী লেখার পার্টটাইম জব। ভালই হবে।
হঠাৎ প্রতিমার মুখখানা ফ্যাকাসে দেখাল। কথাটা বলা হয়তো ঠিক হয়নি। প্রতিমা কিছুক্ষণ মন দিয়ে নিজের হাতের পাতা দেখল। তারপর বলল, একটা মেয়ে বেকার থাকলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু একটা ছেলে বেকার থাকলে ভারী কষ্ট।
কথাটা শুনে মেয়েটাকে আমার ভীষণ ভীষণ ভাল লেগে গেল। সুস্থির চিন্তা ও স্নিগ্ধ মন ছাড়া এরকম সিদ্ধান্তে আসা বড় সহজ নয়। বিশেষ করে তেমন মেয়ের পক্ষে, যে দরিদ্র পরিবারে মানুষ হয়েছে এবং সংসারের প্রয়োজনেই যার পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে চাকরিটা পাওয়া দরকার। আজকাল অনেক বড়লোকের বউ বা মেয়ে স্কুল, কলেজ, অফিসের নানা চাকরি দখল করে বসে আছে। তাদের অর্থকরী প্রয়োজন নেই। নিতান্ত সময় কাটানোবা গৃহ থেকে মুক্তিই তাদের উদ্দেশ্য। এরা যদি জায়গা ছেড়ে দিত তা হলে এই গরিব দেশের অনেকগুলো পরিবার বেঁচে যেত।
প্রতিমার এই কথায় ভিতরে ভিতরে একটা আবেগের চঞ্চলতা অনুভব করছিলাম। সেটার রাশ টেনে একটু উদাস গলায় বললাম, আপনার মতো করে তো সবাই ভাবে না।
প্রতিমা মাথা নিচু করে হাসিমুখে বলল, আমার এমনিতেও চাকরিটা হত না। আমার হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট ভাল নয়।
কিন্তু আপনি যে বি এড, নতুন আইনে বি এড ছাড়া নাকি কাউকে চাকরি দিচ্ছেই না।
আপনাকে দেবে। শুনেছি আপনি অসীমাদির ক্যান্ডিডেট।
আপনি অনেক কিছু শোনেন তো?
প্রতিমা সরল হাসিমুখে বলে, আমার চাকরির জন্য বাবা এত বেশি অ্যাংশাস যে, আপনার সম্পর্কে সব খোঁজ খবর নিয়েছেন। আজ ভোরবেলা কোথা থেকে ঘুরে এসে আমাকে বললেন, তোর হবে না রে। ওই ছেলেটা অসীমার ক্যান্ডিডেট।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, আপনি যা শোনেন তার ফিফটি পারসেন্ট বাদ দেবেন। আমি অসীমাদির ক্যান্ডিডেট নই। উনি আমাকে ভাল করে চেনেনও না। তবে একজন মিডলম্যান কিছু তদবির করেছিল। তাতে তেমন কিছু কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ অসীমাদি খুবই অন্যমনস্ক আর বিমর্ষ ছিলেন সেদিন। আমার হয়ে উনি খুব একটা লড়ালড়ি করবেন না। ওঁর বোধহয় মুড নেই।
লড়ালড়ি করতে হবে না। উনি একবার বললেই হবে। পারিজাতবাবুর কাছে অসীমাদির প্রেস্টিজই আলাদা।
আপনি তা হলে আমার কাছে হেরেই বসে আছেন!
হারতেই যখন হবে তখন আগে থেকে হার মেনে নেওয়াই ভাল।
আমি একটা বড় শ্বাস ফেলে বললাম, আমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম।
কী আন্দাজ করেছিলেন?
আপনি একটু সেকেলে। এখনকার মেয়েরা চাকরির জন্য জান লড়িয়ে দেয়।
জান লড়িয়েও আমার লাভ নেই। অসীমাদির ক্যান্ডিডেটের সঙ্গে পারব কেন!
আপনার বাবাও কি হাল ছেড়ে দিয়েছেন আপনার মতো?
এ কথায় প্রতিমা খুব লজ্জার হাসি হেসে বলল, বাবা একটু কীরকম যেন আছে। কে যেন বাবার মাথায় আইডিয়া দিয়েছে যে, চাকুরে মেয়েদের ভাল বর জুটে যায়।