আমি থাকি নীচের তলায় সামনের দিককার ডানহাতি ঘরখানায়। মাঝারি মাপের ঘরখানা মোটামুটি একটা অফিসের ধাচে সাজানো। মাঝখানে একটা বড় ডেস্ক ও চেয়ার, ফাইল ক্যাবিনেট, টাইপরাইটার, টেলিফোন ইত্যাদি। ঘরের এক কোণে একটা লম্বা সরু চৌকিতে বিছানা পাতা থাকে। আমি রাতে প্রায় সময়েই ওই বিছানায় শুই। কারণ অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করার পর প্রায়দিনই আমার আর ভিতর বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে থাকে না।
অসীমা এই ঘরেই এসে আমার মুখোমুখি বসে। ছোট্ট একটা রুমালে মুখ ও ঘাড়ের ঘাম মোছে। প্রথমেই আমরা কথা শুরু করি না। আমার বা অসীমার কারওরই তেমন কোনও প্রগভতা নেই। তাছাড়া কথা বলার অসুবিধেও থাকে। আমার টাইপিস্ট ছেলেটি সন্ধে সাতটার আগে ছুটি পায় না। বিকেলের দিকে অনেক পার্টিও আসে। সুতরাং অসীমাকে অপেক্ষা করতে হয়।
প্রায়দিনই আমরা কিছুক্ষণের জন্য প্রকৃতির মধ্যে গিয়ে বাগানে বসি। সিংহবাবুদের শখ ছিল। বাগানে তারা চমৎকার কয়েকটা বেঞ্চি বসিয়ে গেছেন। কোনও কোনও বেঞ্চির চারধারে ঘনবদ্ধ কুঞ্জবন। প্রেম করার আদর্শ জায়গা।
আমরা এরকম একটা কুঞ্জবনেই গিয়ে বসি। খুব সাদামাটা ভাবেই আমাদের কথা শুরু হয়।
আমি জিজ্ঞেস করি, অডিটে আর কোনও কিছু রা পড়ল?
হ্যাঁ। ফারনিচার অ্যাকাউন্ট, বুক পারচেজ, রিনোভেশন সবটাতেই গণ্ডগোল।
ইস্কুলে নিশ্চয়ই বেশ উত্তেজনা!
হ্যাঁ।
কী রিঅ্যাকশন দেখলে?
খুব ডিসটার্ব বোধ করছে সবাই।
আমি একটুও চিন্তিত হই না। বলি, আর কী খবর?
কমলাদি খুব ডেসপারেট হয়ে উঠছে।
কীরকম?
অধরবাবু আজ স্কুলে এসেছিলেন।
বলো কী? দিনের বেলায়?
তাই তো দেখলাম। কী বিশ্রী ব্যাপার বলল তো!
কেন এসেছিল?
নিজে থেকে আসেনি। দপ্তরির কাছে শুনলাম কমলাদিই নাকি তাকে চিরকুট দিয়ে অধরবাবুর কাছে পাঠিয়েছিল।
কেন, তা জানতে পারোনি?
না, তবে সেকেন্ড পিরিয়ড থেকে যোর্থ পিরিয়ড পর্যন্ত অধরবাবু কমলাদির চেম্বারে ছিলেন। বাধহয় গারজিয়ানস মিটিং নিয়ে কথা হচ্ছিল।
আমি একটু ভাবলাম। কমলা সেন অসীমাদের হেডমিসট্রেস। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স এবং এখনও কুমারী। অধরবাবু এই শহরের মোটামুটি নামকরা একজন ঠিকাদার। তাঁর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বিবাহিত এবং চার-পাঁচটি ছেলেপুলের বাবা। এঁদের দুজনের মধ্যে একটা অবৈধ সম্পর্ক বহুকাল ধরে চালু আছে বলে গুজব। তবে সম্পর্কটা দেহগত না শুধুই ভাবগত সে সম্পর্কে কেউই নিশ্চিত নয়। কমলা কেন অত্যন্ত দক্ষ প্রশাসক, তার আমলে স্কুলের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। রেজাল্টও দারুণ। কাজেই তার সম্পর্কে অপপ্রচার যা-ই থাক সেটা তেমন গুরুত্ব পায় না। অপরপক্ষে অধরবাবু অত্যন্ত ডাকাবুকো লোক। শোনা যায় তিনিও দারিদ্র্যসীমার তলা থেকে উঠে এসেছেন। একসময়ে ভাল খেলোয়াড় এবং দুর্দান্ত গুন্ডা ছিলেন। তার একটা বেশ বড়সড় দল আছে। অধরবাবুর দানধ্যান এবং পরোপকারেরও যথেষ্ট সুনাম। কমলা সেনের সঙ্গে তার সম্পর্কটা যে রকমই হোক সেটাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখার মতো লোকবল ও অর্থবলের অভাব তার নেই।
কিন্তু এরকম একটা অনৈতিক ব্যাপারকে চলতে দেওয়া আমি উচিত বলে মনে করিনি। জনসাধারণের ঘুম ভাঙিয়ে ব্যাপারটা তাদের গোচরে আনতে আমি প্রথমে শহরে কয়েকটা পোস্টার দিই। তাতে একটু গুঞ্জন উঠলে পরে অভিভাবকদের একটা মিটিং ধারণ করে। অভিভাবকদের মিটিং-এ দুজন রাজনৈতিক নেতাও ভাষণ দেন। বিস্ময়ের কথা হল, কমলা সেন তার বিরুদ্ধে রটনাটাকে অস্বীকার করেননি। স্বীকারও করেননি। অর্থাৎ তিনি মুখ খুলতে চাননি।
আমি বললাম, নজর রেখো।
রাখছি। তবে, কমলাদি খুব রেগে আছেন।
তাই নাকি?
অসীমা একটা ক্লান্তির বড় শ্বাস ছেড়ে বলল, আমার সঙ্গে আজ একটু কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে।
কেন?
আমি অডিটারদের কাছে রোজ যাই এবং কথা বলি বলে।
তাতে দোষ কী?
দোষ তো নেই-ই। কিন্তু উনি ঝগড়া করার একটা পয়েন্ট খুঁজছিলেন।
আমি একটু হাসলাম। বললাম, কিছু বললে ছেড়ে দিয়ো না।
আমি উচিত কথা বলতে ছাড়ি না।
খুব ভাল।আমি উদার গলায় বলি।
অসীমা একটু চুপ করে থেকে সামান্য বুঝিবা বিষণ্ণ গলায় বলল, কিন্তু আমি কমলাদির সঙ্গে কথা কাটাকাটি করায় কলিগরা কেউ খুশি হয়নি।
না হওয়ারই কথা। কমলা সেন সম্পর্কে প্রচার যাই থাকুক, উনি অসম্ভব জনপ্রিয়। সহকর্মীরা ওঁকে বড় বেশি শ্রদ্ধার চোখে দেখে। সুতরাং অসীমা উচিত কথা বললেও সেটা ওদের কাছে অনুচিত শোনাবে। তাই আমি অসীমাকে জিজ্ঞেস করলাম, খুশি হয়নি কী করে বুঝলে?
সবাই অ্যাভয়েড করছিল আমাকে।
আমি কুঞ্জবনের আলো-আঁধার অসীমার শুষ্ক রুক্ষ মুখখানা লক্ষ করছিলাম। বোধহয় সুন্দরের মতো কুৎসিতের মধ্যেও একধরনের আকর্ষণ আছে। আসলে হয়তো সেটা বিকর্ষণই। জটিল এক মানসিক প্রক্রিয়ায় সেইটেই আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে আমি অসীমার মধ্যে সৌন্দর্য বা সৌন্দর্যের অভাব লক্ষ করছিলাম না। আমি বরং ওর মুখে অতি সম্প্রতি যে গভীর ক্লান্তির ছাপ পড়েছে তার কারণটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম।
অসীমা তার স্কুলটিকে বোধহয় ভালবাসে। খুব গভীরভাবেই বাসে। এই স্কুলে কোনও কারচুপি বা হিসেবের গোলমাল ধরা পড়লে সে নিশ্চয়ই খুশি হয় না। কিন্তু তার কিছু করারও নেই। সম্ভবত খুব শিগগিরই সে এই স্কুলের হেডমিসট্রেস হবে। এবং তা হবে কমলা সেনকে সরিয়েই। একসময়ে কমলা সেন সম্পর্কে অসীমার অন্ধ ভক্তি ও ভালবাসা ছিল। আজ নেই। এই সবের মূলে হয়তো আমার অবদানের কথাই সে ভাবে। আর তাই তার ক্লান্তি গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে।