না। এখনও যাইনি।
সর্বনাশ! উনি যে একটু আগে জিপ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
আমি হেসে বললাম, তাড়া কীসের?
গণেশকাকা অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বলেন, তাড়া নেই মানে! জহরবাবু পিছনে জোকের মতো লেগে আছে তা জানিস? কাল রাতেও গিয়েছিল পারিজাতবাবুর কাছে। আজ সকালে অসীম দিদিমণির দাদা গুণেন এসে বলে গেল। এই দেখ, জহরবাবুর ছাতা।
গণেশকাকা কাঁচের আলমারির তলা থেকে একটা বাঁশের উটওলা পুরনো ছাতা বের করে বিজয়গর্বে আমাকে দেখালেন।
কিন্তু জহরবাবুর ছাতা দেখেও আমি উত্তেজিত হলাম না। শুধু নিরুৎসুক গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ওটা পেলেন কোথায়?
কাল পারিজাতবাবুর ওখানে গুণেনবাবুর সঙ্গে জহরবাবুর দেখা হয়েছিল কিনা। ভুল করে গুণেনবাবু জহরবাবুর ছাতাটা নিয়ে এসেছিল। আমাকে দিয়ে গেলেন ফেরত দেওয়ার জন্য।
আমি অসন্তুষ্ট হয়ে বলি, আপনি ফেরত দেবেন কেন? অন্যের ফাইফরমাশ খাটা কি আর কাজ?
গণেশকাকা অতি উদার একটু হাসলেন। বললেন, এটুকু করা কি আর ফাইফরমাশ খাটা রে? ফেরার সময় জহরবাবুর বাড়িতে ফেলে দিয়ে যাব, পথেই পড়বে। গুণেনবাবুর সময় ছিল না।
আমি হাত বাড়িয়ে বললাম, বরং আমাকেই দিন। দিয়ে আসি।
তুই দিবি? তা ভাল কথা।
ছাতা ফেরত দেওয়াটা আমার ছুতো মাত্র। জহরবাবু বা তার মেয়ের সঙ্গে আমার আর একবার মুখোমুখি হওয়া দরকার। মেয়েটার চাকরি কতখানি দরকার তা আমি জানতে চাই। যদি বুঝি ওদের প্রয়োজন আমার চেয়েও বেশি তা হলে আমি চাকরিটা ছোঁব না।
গণেশকাকার নির্দেশমতো জহরবাবুর বাড়ি পৌঁছোতে আমার সময় লাগল সাইকেলে মিনিট দেড়েক। বাড়িটা খুবই পুরনো, জীর্ণ এবং হোট। বাগানের বেড়া ভেঙে পড়েছে বৃষ্টিতে। প্রকাণ্ড একটা গোরু চুকে ফুলগাছ খেয়ে নিচ্ছে আর প্রতিমা একটা ছাতা নিয়ে সেটাকে তাড়ানোর অক্ষম একটা চেষ্টা চালাচ্ছে। বাড়ির সামনে আমাকে নামতে দেখেই সভ য়ে ছাতাটা পিছনে লুকিয়ে ফেলে একদম স্ট্যাচু হয়ে গেল।
আমি বললাম, চিনতে পারছেন? আমি আপনার প্রতিপক্ষ।
প্রতিমা ভারী লজ্জা পেল। আটপৌরে পোশাকে তাকে আজ মন্দ লাগছেনা দেখতে। সাজগোজ বেশি না করলেই যে মেয়েদের বেশি সুন্দর লাগে এই সত্যটা মেয়েরা কখনওই বোঝে না।
প্রতিমা সামান্য একটু হেসে বলল, চিনব না কেন? আসুন।
আপনার বাবা বাড়ি আছেন?
না। বাবা অফিসে গেছেন।
আমি ছাতাটা এগিয়ে দিয়ে বলি, এটা উনি কাল পারিজাতবাবুর বাড়িতে ফেলে এসেছেন। নিন।
প্রতিমা তার পিছনে লুকনো ছাতাটা বের করে চোখ কপালে তুলে বলে, ওমা! তাই আমি ভাবছি, বাবার ছাতায় আমি যে নামের আদ্যক্ষর সাদা সুতো দিয়ে তুলে দিয়েছিলাম সেটা কোথায় গেল।
আমার ছাতা বিনিময় করলাম। সেইসঙ্গে হৃদয় বিনিময়ও হয়ে গেল কি না বলতে পারব না। তবে এই সময়ে প্রকাণ্ড গোটা একটা কলাবতী ফুলের গাছ মুড়িয়ে মসস করে খাচ্ছিল। আমরা সেটা দেখেও দেখলাম না।
হাঁস যেমন গা থেকে জল ঝড়ে প্রতিমা তেমনি লজ্জাটা ঝেড়ে ফেলে খুব স্মার্ট হয়ে গেল। বলল, আসুন, গরিবের বাড়ি চা খেয়ে যান। কষ্ট করে এসেছেন।
প্রতিমারা বাস্তবিকই গরিব। ঘরের দেয়ালে বহুকাল কলি ফেরানো হয়নি। বর্ষায় নোনা ধরে গেছে। বাইরের ঘরে তিনটে টিংটিঙে বেতের চেয়ার আর একটা ছোট্ট চৌকি। দেয়ালে কিছু সূচিশিল্প, একটা নেতাজির ছবিওলা ক্যালেন্ডার আর গোবরের চাপড়ার ওপর তিনটে কড়ি লাগানোদরজা জানলা বড়ই নড়বড়ে। একটা জানলার পাল্লায় ছিটকিনি নেই, তার বদলে পাটের দড়ি লাগানো।
কারা বেশি গরিব, প্রতিমারা না আমরা, তা ভাবতে ভাবতেই প্রতিমা ভিতরবাড়ি থেকে এক পাক ঘুরে এসে আমার মুখোমুখি চৌকিতে বসল।
চাকরিটা আপনারই হবে! বলল সে।
কেন?
আমার তেমন ইচ্ছে নেই।
তাই বা কেন?
আমি পারিজাতবাবুর জীবনী-টীবনী লিখতে পারব না। বাবা ভীষণ বোকা। কেবলই আমাকে খোঁচাচ্ছে, পারিজাতবাবুর জীবনী লিখতে। বলুন তো, এসব করতে সম্মানে লাগে না?
আমি বললাম, জীবনী লেখার কথাটা আমিও সেদিন শুনেছি। ব্যাপারটা কী বলুন তো! এত লোক থাকতে হঠাৎ পারিজতাবাবুর জীবনী লেখার কী দরকার পড়ল?
আমারও তো সেই প্রশ্ন। বাবাকে বহুবার জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু বাবা কেবল বলে, লোকটা অহংকারী। জীবনী লেখার কথা শুনলে খুশি হয়।
হয় নাকি?
তা কে জানে। আমি লোকটাকে ভাল চিনি না। তবে শুনেছি, পারিজাতবাবু ভাল লোক নন।
আমিও ওরকমই শুনেছি। তবে লোকটাকে আমার খুব খারাপ লাগেনি।
কিন্তু লোকটা খারাপই। ওর বউ আত্মহত্যা করেছিল জানেন?
তাই নাকি?
বিষ খেয়ে। সবাই বলে ওটা খুন।
তদন্ত হয়নি?
কে জানে! হলেও পারিজাতবাবুকে ধরা সহজ কাজ নয়।
আপনি জানেন, খুন?
তা-ই তো সবাই বলে।
যাঃ। ওসব গুজব। বুদ্ধিমান লোকেরা কখনও বউকে খুন করে না।
তা হলে কী করে?
ডিভোর্স করতে পারে। খামোক খুন করতে যাবে কেন?
বামোকা মোটেই নয়। ওর বউ অনেক গোপন খবর রাখত। সেগুলো ফাস করে দিতে চেয়েছিল বলেই একদিন বেচারার জলের গেলাসে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়। মাঝরাতে ঘুমের চোখে সেই জল খেয়ে মেয়েটা মরে গেল।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, গোপন খবরটা কী রাখত ওর বউ?
পারিজাতবাবুর অনেকরকম বে-আইনি কারবার আছে তো। সেইসব।
আমি পা নাচিয়ে লঘু স্বরে বললাম, তা হলে আর পারিজাতের দোষ কী? গোপন খবর ফাঁস করতে চাওয়াই তো অন্যায়। আইন ওটাকে বলে ব্ল্যাকমেল।