এসব আমার অভ্যাস নেই বটে, তা বলে খুব খারাপ লাগছে না। এই গাঁয়ে আমার জন্ম। জন্মভূমির প্রতি মানুষের এক দুরারোগ্য আকর্ষণ থাকবেই। তার কোনও যুক্তিসিদ্ধ কারণ থাক বা না থাক। এই গাঁয়ের আরও একটা আকর্ষণ ফুলমাসি। আমার প্রতি তার মেহ যুক্তিসিদ্ধ নয়। আমি তার জামাই হতে পারতাম। কিন্তু হইনি। তবু আমার প্রতি তার এক দুর্জয় দুর্বলতা। কারণটা আমি কখনও খুঁজে দেখিনি। যাকগে, কিছু জিনিস না জানলেও চলে যায়। হয়তো না জানাই ভাল।
সকালে যখন সাইকেলটা চাইতে গেলাম তখন ফুলমাসি চা আর তার সঙ্গে রুটি বেগুনভাজা খাওয়ালেন। খেতে খেতে একসময়ে বলেই ফেললাম, খুব তো আদর দিয়ে মাথায় তুলছ। পরে বুঝবে।
কী বুঝব রে?
যদি চাকরি পাই তো পাকাপাকি আস্তানা গাড়তে হবে এখানে। তখন রোজ জ্বালাতন হয়ে বলবে, অভীটা গেলে বাঁচি।
তাই বুঝি! তুই তো হাত গুনতে জানিস।
আমি মাথা নেড়ে বলি, পাকাপাকিভাবে থাকলে দাম কমে যাবে।
মাসি ঝগড়ার গলায় বলল, সে যদি কমেই তা হলে বরং তোরকাছেই আমার দাম কমবে। তখন বন্ধু হবে, বান্ধব হবে, আড্ডা হবে, মাসি মরল কি বাঁচল কে তার খোঁজ করে। আর যদি বিয়ে করিস তবে তো আর কথাই নেই। বছর ঘুরলেও বাছা আর এমুখো হনে না।
এসব অবশ্য কথার কথা। সবকিছুই নির্ভর করছে একটা জিনিসের ওপর, চাকরিটা আমার হবে কি হবে না। জহরবাবু তার মেয়েকে ঢোকানোর জন্য যে পন্থা নিয়েছেন তা যদি সফল হয় তবে আমার হওয়ার চান্স নেই। কিন্তু পারিজাত লোকটিকে আমার বুদ্ধিমান বলেই মনে হয়েছে। লোকটা জহরবাবুর ফাঁদে পা দেবে বলে মনে হয় না। যদি প্রতিমা আর আমার মধ্যে ওপেন কমপিটিশন হয় তবে আমার চান্স কিছু বেশিই। প্রতিমা বি এড, কিন্তু হায়ার সেকেন্ডারিতে আমার রেজাল্টটা একটু ভাল। চাকরিতে এই পরীক্ষাটার রেজাল্টই গুরুত্ব পায় বেশি।
বড় রাস্তায় উঠে দেখি, বহু লোকজন জড়ো হয়েছে। রাস্তার উল্টোদিকের মাঠেও বহু লোক। চাংড়াপোতার বাঁধের ওপর সারসার লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের হাতে লাঠি-সোটা। বেশ একটা উত্তেজনার ভাব চারদিকে।
একজন চায়ের দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হে মোড়ল, গণ্ডগোল নাকি?
লোকটা আমায় চেনে। বলল, চাংড়াপোতার লোকেরা বাঁধ কেটে দিতে এয়েছিল। তাই সবাই বাঁধ পাহারা দিচ্ছে।
ইরিগেশনের খালের ওপাশে চাংড়াপোতা। জায়গাটা আমি চিনি। ওখানকার ঝিঙে খুব বিখ্যাত। বললাম, বাঁধ কাটতে চায় কেন? ওপাশে জল নাকি?
খুব জল। চাংড়াপোতায় শুধু বাড়িঘরের চালটুকু দেখা যাচ্ছে, আর সব জন্মে তলায়।
আমি একটু শিউরে উঠলাম। বাঁধ কেটে দিলে মউডুবি চোখের পলকে সাগরদিঘি হয়ে যাবে। ঘরে বুড়ো দাদু।
আমি দোকানিকে বললাম, মারদাঙ্গা লাগলে আমাকে খবর দিয়ে। আমিও জুটে যাবখন। পাহারা দিতে হলে তাও দেব।
লোকটা হেসে বলল, দরকার হবে না। আমরা তো আছি। সকলেরই জান কবুল।
লাশ টাশ পড়েছে নাকি?
আজ্ঞে না।
আমি খানিকটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে রওনা হলাম। মনে মনে একটু হাসিও পাচ্ছে। আমরা কত না স্বার্থপর! চাংড়াপোতা ডুবুক, মউড়ুবি না ডুবলেই হয়। অন্যে মরছে মরুক, আমরা বেঁচে থাকলেই হয়। এই স্বার্থপরতাই এখন ভারতবর্ষের জীবন-বেদ। আমরা তার মধ্যেই লালিত-পালিত হয়েছি। আমাদের জ্যেষ্ঠরা এর চেয়ে বেশি কিছু আমাদের শেখাতে পারেননি।
অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। চাংড়াপোতা থেকে খাল পার হয়ে একটা ছেলে স্কুলে পড়তে আসত। তখনও চাংড়াপোতায় স্কুল হয়নি। সেই ছেলেটা ছিল বিশু। আমার খুব বন্ধু। একবার তার বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর নেমন্তন্ন খেয়েছিলাম।
কে জানে বিশু এখনও বেঁচে আছে কি না। না থাকার কথা নয়। কিন্তু আজকাল আমার বয়সি ছেলেদেরও বেঁচে থাকা সম্পর্কে একটা সংশয় দেখা দিয়েছে। অবশ্য বিশু বেঁচে থাকলেও যে চাংড়াপোতাতেই আছে এমন নয়। আবার থাকতেও তো পারে!
একবার ইচ্ছে হল, সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে চাংড়াপোঁতার দিকটা দেখে আসি। তারপর ভাবলাম, থাক। কী দরকার? কিছু ব্যাপার সম্পর্কে উদাসীন থাকাই ভাল।
আজ বৃষ্টি নেই। মেঘ-ভাঙা একটু রোদও উঠেছে। গাছপালা আর ভেজা মাটির গন্ধ ম ম করছে। আমি বুক ভরে দম নিলাম। পোটলা-পুঁটলি নিয়ে কিছু লোক গাছতলায় বসে গেছে। ইটের উনুনে রান্না চাপিয়েছে কেউ কেউ। কিছু লোক পায়ে হেঁটে চলেছে শহরের দিকে। বুঝতে অসুবিধে নেই, আশপাশের নিচু জায়গাগুলো জলে ডুবেছে।
ডুববেই। বহুকাল ধরে এ দেশের নদীগুলির কোনও বিজ্ঞানসম্মত সংস্কার হয়নি। অধিকাংশ নদীখাতই পলি পড়ে পড়ে অগম্ভীর হয়ে এসেছে। এক ঢল বর্ষার জলও বইতে পারে না। নিকাশি খাল সংখ্যায় অপ্রতুল। প্রতিবছর তাই কোচবিহার থেকে মেদিনীপুর অবধি প্রায় সব জেলাই ভাসে। বছরওয়ারি এই কন্যা সামাল দেওয়া কিছু শক্ত ছিল না। চাংড়াপোঁতার দিককার বাঁধ যদি যথেষ্ট শক্ত-পোক্ত হত তা হলে গ্রামটা ভেসে যেত না। আমি জানি, খরার সময় ওই সেচখাল শুকিয়ে খটখটে হয়ে যায়। আর ভারী বর্ষা হলে সেই খালই হয় বানভাসি।
সাইকেল নিয়ে আমি সারা শহর কয়েকবার টহল দিলাম। বলতে কি পারিজাতের বাড়ি হানা দিতে আমার একটু লজ্জা-লজ্জাই করছে।
গণেশকাকার দোকানে নামতেই গণেশকাকা বলেন, পারিজাতবাবুর বাড়ি হয়ে এলি?