দাদু বার দুই এসে হ্যারিকেনটা দেখলেন। তারপর থাকতে না পেরে বললেন, কে দিল? গণেশের বউ নাকি?
হ্যাঁ।
তেল পাচ্ছে কোথায়? মহিমের দোকানে এসেছে বুঝি?
কেন, আপনার লাগবে? গণেশকাকাকেবললেই এনে দেবে।
দাদু ঠোঁট উলটে বললেন, তেল দিয়ে কী করব? হ্যারিকেনই নেই। পুরনো দু-তিনটে যা-ও ছিল সব ভেঙে গেছে।
তা হলে তো কথাই নেই।
হ্যারিকেনটা তো বেশ মজবুত দেখছি। ব্রিটিশ আমলে জার্মান হ্যারিকেন পাওয়া যেত। হেঁচা জিনিস, বহুদিন চলত। এখনকার দিশিগুলো বড় হলকা পলক।
সে জিনিস আর কোথায় পানে?
আজকাল হ্যারিকেনের দাম কত হয়েছে বলো তো!
যেমন জিনিস তেমন দাম। তবে পনেরো-ষোলো টাকার নীচে বোধহয় পাওয়া যায় না।
ও বাবা। এত? দিনে কালে হল কী?
সেই কথাই তো সবাই বলাবলি করে আজকাল।
একটু আগে ধুপ করে একটা শব্দ হল শুনেছ?
না তো।
হয়েছে। পুরনো পাকঘরের পিছনের গাছটা থেকে নারকোল পড়ল।
ও।
একবার যাও না। নিয়ে এসো।
এত রাতে।
রাত কোথায়? হ্যারিকেনটা নিয়ে যাও। নইলে সকালে ফুলকুড়ুনিরা এসে নিয়ে যাবে। রোজ নিয়ে যায়।
যাক না। একটা নারকোল গেলে যাবে।
রোজ একটা দুটো করে গেলে বছরে কতলে যায় হিবে করেছ?
আমি বিরক্ত হয়ে বলি, বাইরে তো এখন একটু জল।
তোমাকে বলতাম না। আমি নিজে রাতবিরেতে চোখে দেখি না। পড়ে-উড়ে গেলে মুশকিল।
একটা টর্চ দিন।
টর্চ কীসে লাগবে। হ্যারিকেনটা নিয়ে যাও।
গত দুদিনে দাদুকে আমি প্রায় চার বস্তা নারকোল বিক্রি করতে দেখেছি। গড়পরতা এক একটার দর পাঁচ সিকে। চার বস্তায় কমকরেও শত খানেক নারকোল হবে। দাদুর আয় সে হিসেবে মন্দ নয়। তবু একটা টর্চ কিনবেন না। কিংবা হয়তো আছে, বের করবেন না।
অগত্যা হ্যারিকেনটা নিয়ে বেরোতে হল। একটু আগেই বৃষ্টি থেমেছে। কিন্তু আকাশ গোঁ গোঁ করছে। দাপটের সঙ্গে বইছে বাতাস। হ্যারিকেনের লাফাতে লাগল।
দাদু তার মোটা বেতের লাঠি এগিয়ে দিয়ে বললে, এটা সঙ্গে নিয়ে যাও। লতা-টতা অবশ্য এই দুর্যোগে বেরোয় না। তবে হেলে ঢোঁড়া আছে। সঙ্গে লাঠি রাখা ভাল।
দাদুর অনুমান যে নির্ভুল তাতে আমার সন্দেহ ছিল না। এই বাড়ির সঙ্গে দাদুর সমস্ত সত্তা এমন জড়িয়ে গেছে যে, ঘরে বসে থেকেও একটা অদৃশ্য অ্যানটেনা দিয়ে কোথায় কী ঘটছে তা টের পান।
পুরনো রান্নাঘরের পিছনে জঙ্গলের মধ্যে বাস্তবিকই নারকোলটা পাওয়া গেল। সেটা বগলদাবা করে ফেরার সময় আমার কিন্তু বিরক্তিটা রইল না। কেমন যেন একটা মায়া জন্মাল। নিজের বাড়ি, নিজের জমি, নিজেদের দখলি গাছপালা, এর একটা আলাদা ব্যাপার আছে। সব কিছুই পয়সা দিয়ে কিনতে হচ্ছে না, কলকাতায় আমরা এরকমটা ভাবতেই পারি না। সেখানে কান চুলকোনোর জন্যও পয়সা দিতে হয়।
ঘরে এসে দাদুর হাতে নারকোলটা দিতেই উনি নেড়ে দেখলেন, জলের শব্দ হচ্ছে কি না। তারপর চৌকির নীচে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার চাকরির কী হল?
এখনও কিছু হয়নি।
হবে মনে হয়?
না হওয়ারই কথা। আর একজন লোকাল ক্যান্ডিডেট আছে।
কে বলো তো!
জহরবাবু নামে এক ভদ্রলোকের মেয়ে।
জহর বাঁড়ুজ্জে নাকি?
হতে পারে। পদবিটা জানি না।
ইরিগেশনে এক জহর আছে জানি তার মেয়ে কি তোমার চেয়ে বেশি পাশ?
হ্যাঁ। বি এড।
দাদু অসন্তুষ্ট হয়ে বলেন, তা তুমি এতদিন ঘরে বসে কোন ভেরেন্ডা ভাজছিলে? বি এডটা পাশ করতে পারোনি?
তখন কি জানতাম যে মাস্টারি করব?
তা বলে একটা মেয়ে তোমাকে লেখাপড়ায় ডিঙিয়ে বসে থাকবে, এ কেমন কথা?
ডিঙিয়ে বেশিদূর যায়নি। তবে একটা পাশ বেশি করেছে বটে।
তবে?
আপনি উতলা হচ্ছেন কেন? পারিজাতবাবু এখনও আমাকে না করেননি।
কী বলেছে?
গণেশকাকা খোঁজ রাখছে। যা বলার ওঁকেই বলবে।
আবার ডেকে পাঠাবে বলছ?
পাঠাতেও পারে।
চাকরি তোমার একটা হওয়া দরকার। যদি এখানে থাকতে পারো তো খুব ভাল।
দেখছি কী হয়।
ঘরে বসে সময় না কাটিয়ে একটু পারিজাতের কাছে যাতায়াত করলেও তো পারো।
তদবির করতে বলছেন?
উপায় কী? তদবির বরাবরই করতে হত। এখনও হয়।
ওসব আমি ভাল পারি না।
পারতে হয়। তুমি এখানে থেকে চাকরি করলে শেষ বয়সে আমাকে আর বাস্তুভিটে বিক্রি করতে হয় না। তুমিই সব দেখেশুনে রাখতে পারবে।
চেষ্টা তো করছি।
তুমি চেষ্টা করছ না। একে কি চেষ্টা বলে?
আমার হয়ে গণেশকাকা করছেন।
গণেশটা এমনিতে ভাল লোক, কিন্তু কথায় বার্তায় পোক্ত নয়। ও কি পারবে? তুমি নিজেই কাল একবার যাও। রোজই যাও। ওতে ব্যাপারটা ভুল পড়বে না। তোমাকে দেখলে মনে পড়বে।
মেয়েটার বাবা খুব তেল দিচ্ছে।
দেবেই। চাকরির যা বাজার! তুমি কাল সকালেই যাও। একটা মেয়ের কাছে হেরে এসো না।
দাদু কথাটা ভুললেন না! ভোর না হতেই আমাকে ঠেলে তুলে দিলেন, ওঠো, ওঠো, বেলা হয়ে যাবে। এইবেলা বেরিয়ে পড়ো।
জ্বালাতন আর কাকে বলে। তবে উঠতেও হল।
পারিজাতবাবুকে গিয়ে আমি কী বলব তা আমার মাথায় এল না। অনিকভাবে ধীরে ধীরে চারদিক দেখতে দেখতে আমি সাইকেল চালাতে থাকি।
চারদিকে আজ অবশ্য জল ছাড়া প্রায় কিছুই দেখার নেই। সাইকেলের চাকা সিকিভাগ জলের তলায়।খানা-খন্দে পড়ে ঝাং ঝাং করে লাফিয়ে উঠছে। কোথাও ঋথকে আঠালো কাদায় পড়ে থেমে যাচ্ছে ঘচাৎ করে। আমার প্যান্টের নিম্নাংশ গুটিয়ে রাখা সত্ত্বেও কাদায় মাখামাখি হল। একজোড়া হাওয়াই চপ্পল ধার দিয়েছে ফুলমাসি। সেও কাদা থেকে টেনে তুলতে গিয়ে একটা স্ট্র্যাপ ফচাক করে খুলে গেল।