এই একজন লোক যিনি এখনও কিভাবে আমার দলে। অন্য কতদিন ইন আমার দলে থাকবেন তা বলা শক্ত। প্রতিমার চাকরিটানাহলে হয়তো চট করে দলবদলে ফেললো এই যুগে দল বদলের একটা বীজাণু এসে গেছে।
জহরবাবু ঘরে ঢুকতেই গুণেবাবুচলি হেপারিজাত বলে উঠেপড়লেন। আমিরুকরলাম, গুণেনবাবু যাওয়ার সময় ভুল করে নিজের ছাতটার বদলে অহরবাবুর মুতাটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি কিছুই বললাম না। এইছতা দলের সঙ্গে সঙ্গে যদি দুজনের মানসিকতারও একটু বদল হয়? হতেও তো পারে! দুনিয়ায় কি অঘটন আজও ঘটে না।
জহরবাবু বসে রুমাল দিয়ে ভাল করে মাথা মুছেবললেন, ওঃ! প্রতিমা তো সেই থেকে কেবই আপনার কথা বলছে। যেমন সুন্দর চেহারাখানা, তেমনি অমায়িক ব্যবহার, প্রসায় একেবারে পঞ্চমুখ।
কথাটায় সত্যতা কত পারসেন্ট তা হিবে করতে তেও আমি বেশ খুশিই বোধ করলাম। সুন্দরী যুবতী মেয়েদের আমি তেমন করে আকর্ষণ করার চেষ্টা কখনও করিনি বটে, কিন্তু কেউ আকৃষ্ট হয়ে থাকলে ভালই লাগে।
বললাম, তাই নাকি?
আর বলবেন না। দিনরাত শুধু আপনার কথা। আজ দুপুরে ওর মাকেও বললি, পারিজাতবাবু দরিদ্র অবস্থা থেকে যেভাবে ওপরে উঠে এসেছে তা নিয়ে একটা উপন্যাস লেখা যায়। আপনার জীবনী লেখার জন্য তো ও একেবারে মুখিয়ে আছে।
জহরবাবু সেই জীবনীপ্রসঙ্গেই আটকে আছে। র মনটা হল খারাপ আমোফান রেকর্ডের মতো। যেখানে পিন আটকায় ঘুরেফিরে সেই জায়গাটাই বাজতে থাকে।
তবু এইসব কথাতেও আমি কেন যেন খুশি হৰি। স্তাবকতা যে মানুষের কত বড় শত্রু। বেশ খোশ গলায় বললাম, তাই নাকি?
জহরবাবু হঠাৎ টেবিলে ভর দিয়ে একটু ঝুঁকে চাপা গলায় বললেন, ওই ছোকরাটাকে আপনি জোটালেন কোথা থেকে বলুন তো!
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন ছোকরা?
ওই যে অভিজিৎ গাঙ্গুলি না কী যেন নাম।
আমিও চাপা গলায় বললাম, কেন বলুন তো।
আরে দূর! দূর! ও মাস্টারি করবে কী মশাই? ও তো ডেনজারাস নকশাল।
তাই নাকি?
আরে হ্যাঁ, বলছি কী তা হলে? মউডুবির বঙ্কিম গাঙ্গুলির নাতি। বংশটাই গোঁয়ার গোবিন্দ টাইপের। এ ছোকরা তো শুনি খুনটুনও করেছে।
কোথা থেকে শুনলেন?
খবর নিয়েছি আর কি! ও ছোকড়া স্কুলে ঢুকলে স্কুল লাটে তুলে দেবে।
আমি গম্ভীর হয়ে বলি, তা হতে পারে। তবে ছেলেটা লেখাপড়ায় ভাল। হায়ার সেকেন্ডারিতে তিন বিষয়ে লেটার পেয়েছিল।
নির্বিকার মুখে মিথ্যে কথাটা বলে আমি জহরবাবুর রিঅ্যাকশন লক্ষ করতে লাগলাম। জহরবাবু অসহায়ভাবে নিজের ঠোঁট দুটো গিলে ফেলার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, তিনটে লেটার!
তিনটে বলেই তো জানি।
টুকেছে তা হলে। বোমা বন্দুক বানিয়ে আর মানুষ খুন করে পড়াশুনোর সময়টা পেল কখন বলুন।
এই একটা ব্যাপার সম্পর্কে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা খুব গভীর। তাই আমি খুব গম্ভীর হয়ে জহরবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কখনও পরীক্ষায় টুকেছে?
আমি!-জহরবাবু থতমত খেয়ে বললে,কী যে বলেন!
আমি মাথা নেড়ে বললাম, তা হলে আপনার একটা জিনিস জানা নেই। টুকে পাশ করা যায় বটে, কিন্তু কিছুতেই লেটার পাওয়া যায় না। কারণ চোথা দেখে দেখে খাতায় তুলতে ডবল সময় লাগে। তার ওপর গার্ডের দিকেও নজর রাখতে হয়। যদি টোকার অভিজ্ঞতা থাকত তা হলে বুনে, তিন ঘটায় মেরেকেটে ত্রিনিক্সের ব্যবস্থা করা যায় বটে, কিন্তু কিছুতেই লেটার পাওয়া যায় না। তা যদি যেত তা হলে আমিও হায়ার সেকেন্ডারিতে সব কটা বিষয়ে লেটার পেতাম।
জহরবাবু আমার স্বীকারোক্তিতে ভারী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আবার নিজের ঠোঁট দুটো গিলে ফেলার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন, তাই বুঝি।
আমি গলায় যতদূর সম্ভব বিষাদ মাখিয়ে বললাম, হ্যাঁ জহরবাবু, আমিও টুকেই পাশ করেছি। সবকটা বিষয়ে।
জহরবাবু সজোরে গলা খাঁকারি দিয়ে চট করে লাইন পালটে বললেন, আপনার কথা আলাদা। একদিকে তীব্র দারিদ্র্য, অন্যদিকে সাতিক জীবন সংগ্রাম। মরণপণ লড়াই। হয়তো ঘরে বাতি জ্বালাবার মতো কেরোসিন নেই বই নেই, খাতা নেই, পেনসিল নেই। অথচ পাশ করতেই হবে। ওরকম কনডিশনে মশাই, আমার তো মনে হয় না টোকা অপরাধ।
আমি মোলায়েম গলায় বললাম, কথাটা প্রতিমাকে বলনে।
কোন কথাটা?
আমি যে পরীক্ষায় টুকে পাশ করেছি সেই কথাটা। ও তো আমার জীবনী লিখবে, ওর এসব জানা দরকার।
খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জহরবাবু বললেন–বলব। কিন্তু দেখবেন, ও আপনাকে ভুল বুঝবে না। আপনার ওপর ওর এ এতই বেশি যে, আপনার প্রতিটি কাজের মধ্যেই ও একটা মহত্ত্ব দেখতে পায়। কিন্তু ওই অভিজিৎ ছোঁড়া সম্পর্কে আমার একটু খিচ থেকেই গেল। অতগুলো লেটার ও বাগালে কী করে? ওর হয়ে অন্য কেউ পরীক্ষা দেয়নি তো?
তা কী করে বলব? দিতেও পারে।
লেটার প্রতিমাও গোটাকয় পেত, বুঝলেন পারিজাতবাবু! কিন্তু আচমকা টাইফয়েড হয়ে সব ওলটপালট হয়ে গেল। টাইফয়েড বড় সাংঘাতিক জিনিস। পরীক্ষার আগে মাস দুয়েক তো প্রতিমা বই খুলতেই পারত না। অক্ষরের দিকে তাকালেই মাথা ঝিমঝিম করত।
বটে! তারপর?
সে আর বলেন কেন? আমি গরিব মানুষ, কষ্টেসৃষ্টে একজন ভাল মাস্টার রাখলাম। মাস্টার পড়ত, প্রতিমা শুনত। কিন্তু ব্রেনটা ভাল বলে শুনেই মনে রাখতে পারত।
ওভাবেই পরীক্ষা দিল?
পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না সেবার মেয়েটার। বলেও ছিল, এক বছর ড্রপ দিয়ে পরের বছর পরীক্ষা দিলে গোটা তিন-চার লেটার পাবেই। তা আমি রাজি হলাম না। আবার বছরটাকের ধাক্কা।