প্রতিপক্ষ হিসেবে অধর চমৎকার। শক্তিমান, আত্মবিশ্বাসী, বুদ্ধিমান। বলতে কী, এই অঞ্চলে আমার নিরঙ্কুশ প্রাধান্য তার জন্যই খানিকটা আটকে আছে। আমাদের মধ্যে একটা শেষ লড়াই হওয়া দরকার। সেটা আসন্ন বলেই আমার অনুমান। এক আকাশে যেমন দুই সূর্যের স্থান নেই তেমনিই এই জায়গার পক্ষে দু-দুজন ধুরন্ধর একটা বিশাল বাহুল্য মাত্র। হয় তাকে উচ্ছেদ হতে হবে, নয়তো আমাকে।
অনেকেরই ধারণা অধরের প্রেস্টিজে হাত দেওয়া আর জাতসাপের লেজ দিয়ে কান চুলকোনো একই ব্যাপার। আমি অবশ্য এরকম কোনও বিশ্বাসে বিশ্বাসী নই। দারিদ্র্যসীমার ওই রেলবাঁধটা ডিঙোতে গিয়ে আমাকে বহু উঁচু ও নিচুতে ঠোক্কর খেতে হয়েছে এবং বিবিধ জাতসাপের লেজ দিয়ে বে-খেয়ালে বহুবারই আমি কান চুলকে ফেলেছি। সেই জাতসাপগুলো এখনও বেঁচে আছে কি না আমি তা সঠিক জানি না। কিন্তু আমি বেঁচে আছি। আসল কথা হল, সাপ যেন মানুষের শত্ৰু, তেমনি মানুষও সাপের শত্রু। অন্যের দাঁত নখ দেখে অধিকাংশ মানুষই ভয়ে পিটিয়ে থাকে। কিন্তু তারা ভুলে যায় যে, ভগবান তাদেরও যথেষ্ট দাঁত নখ দিয়েছেন।
সন্ধেবেলায় আমি একথাটাই গুণেনবাবুকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম। গুগেনবাবু খুব মনোযোগী শ্রোতা নন। সাধারণত পণ্ডিত ও বক্তারা অন্যের কথা শুনতে ভালও বাসেন না। কিন্তু আজ গুণেনবাবুকে খুবই অন্যমনস্ক ও বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। উনি আমার সব কথাতেই ই দিয়ে যাচ্ছিলেন। অনেকক্ষণ শোনার পর বললেন, দাঁত নখের ইতিহাস খুবই প্রাচীন। আবহমানকাল ধরেই মানুষ ও অন্যান্য পশু দাঁত নখ ইত্যাদি ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বলে একটা কথা আছে পারিজাত।
আমি মাথা নেড়ে বলি, হ্যাঁ, ওরকম একটা কথা প্রায়ই আমার কানে আসে।
গুণেনবাবু একটু চিন্তিত মুখে বলেন, কানে তো আসে, কিন্তু কথাটার মানে জানো?
খুব ভাল জানি না।
সোজা কথা হল, দাঁত নখ যদি কোনওদিন ঈশ্বরের কৃপায় লোপাট হয়ে যায় তবে অন্য কথা। কিন্তু যতদিন মানুষের দাঁত নখ থাকবে ততদিন তারা সেটা ব্যবহার করতেও ছাড়বে না। আমাদের শুধু দেখতে হবে, মানুষ যেন অপ্রয়োজনে বা সামান্য কারণেই তা ব্যবহার না করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হল একটা আপসরফা মাত্র। দুর্বল ও সবলের মধ্যে একটা নড়বড়ে সাঁকো বাঁধার চেষ্টা। তবু সেই চেষ্টাটাই হচ্ছে মনুষ্যত্ব।
আমি একটা হাই গোপন করার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললাম, তা হবে।
গুণেনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, অধরের সঙ্গে তোমার যদি একটা শো-ডাউন হয়ই তবে সেটা হবে দুটো বিগ পাওয়ারের লড়াই আমাদের তাতে কোনও প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই। কিন্তু মনে রেখো, দুটো বড় শক্তির লড়াই যখন লাগে তখন কিছু উলুখাগড়ারও প্রাণ যায়। আমার ভয় সেখানেই।
আমি ভ্রু কুঁচকে নিজের নখ দেখতে লাগলাম।
উনি বললেন, অধর লোকটা খুব খারাপ নয় পারিজাত। ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি তো। একটু মাথাগরম গা-জোয়ারি ভাব আছে বটে, কিন্তু মানুষের দায়ে দফায় ও সবার আগে গিয়ে বুক দিয়ে পড়ে। এই তো সেদিনও মেথরপট্টির একটা মড়া পোড়ানোর টাকা দিল, নিজে কাঁধে করে মড়া বইল পর্যন্ত। একসময়ে ওর নামই হয়ে গিয়েছিল এ শহরের রবিন হুড।
আমি বিনীতভাবেই বললাম, আমি জানি।
গুণেনবাবু একটু চাপা স্বরে বললেন, আমি বলছিলাম কি ওর সঙ্গে একটা মিটমাট করে নাও।
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তো?
ধরো তাই।
তা হলে এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ব্যাপারটা আপনি অধরবাবুকেও একটু বুঝিয়ে বলুন না।
গুণেনবাবু অসহায়ের মতো মুখ করে বললেন, মুশকিল হল, তুমি আমার হবু ভগ্নীপতি। তাই অধর ধরেই নিয়েছে যে, আমি তোমার পক্ষে। কাজেই সে আমার কথা কানে তুলছে না। কমলার ব্যাপারটাতেও সে খুব পারটারবড়।
তা হলে আর কী করা যায় বলুন!
কমলা আর অধরের ব্যাপারটাকে আমি সাপোর্ট করছি না পারিজাত। আমি মানি, কোনও স্কুলের হেডমিসট্রেসের ব্যক্তিগত জীবনে কোনও কলঙ্ক থাকা উচিত নয়। তবু এতকাল এটা নিয়ে উচ্চবাচ্য যখন করেনি তখন তুমিই বা হঠাৎ ময়লার গামলায় খোঁচা দিতে গেলে কেন?
আপনারা এতকাল ধরে একটা দুর্নীতি ও ব্যভিচারকে সমর্থন করে আসছেন কেন সেটা আমি আজও বুঝতে পারি না। হয়তো অধবকে আপনারা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ভয় পান এবং কমলা সেনের যোগ্যতা সম্পর্কে আপনাদের ধারণাও অনেকটাই অতিরঞ্জিত।
গুণেনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে গেলেন। আজ উনি তর্ক করার মুডে নেই। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কথাটা হয়তো তুমি ঠিকই বলেছ। তবু বলি, তুমি যদি কিছু মনে না করো তবে আমি তোমার সঙ্গে অধরের একটা মিটমাট ঘটানোর শেষ চেষ্টা করে দেখতে পারি।
আপনি অত ভয় পাচ্ছেন কেন?
গুণেনবাবু মরা মাছের চোখের মতো এক ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে আমাকে দেখতে দেখতে বললেন, অধরের হাতে অনেক লোক আছে।
আমি মৃদু হেসে বললাম, আমি জানি অধরবাবুর হাতে অনেক লোক এবং তাও আছে। তদুপরি তিনি হলেন লোকাল লোক, যাকে বলে ভূমিপুত্র। তিনি এখানকার রবিনহুডও বটে। শহরের বেশিরভাগ লোকেরই সমর্থন অধরের দিকে। এ সবই আমি জানি। আমি তার সঙ্গে লাগতেও চাই না। কিন্তু একটা অন্যায়ের প্রতিকার হওয়া উচিত বলে মনে করি।
গুণেনবাবু চুপ করে গেলেন। অবশ্য এর চুল আর অন্য একটা কাল লি। ঘরের বাইরে ভেজা ছাতাটা বারান্দায় রেখে জহরুবাবু গায়ের অলআড়ছেন। মুখে বিগলিত হাসি।