শিবপ্রসাদ স্কুলের প্রতিটি ইট কমলা সেনের মতোই তার কাছেও বুকের পাঁজর।
চোখ বুজে অসীমার মানসিকতার মধ্যে আমি এমন ডুবে ছিলাম যে আকস্মিক একটা আর্ত চিৎকারে প্রায় লাফিয়ে উঠতে হল।
পরমুহূর্তেই অবশ্য ভুল ভাঙল। চিৎকার নয়, গান। মনে ছিল না যে, রবিবার সকালে এই স্কুলে একটা গানবাজনার স্কুলের ক্লাস হয়।
আমি উঠে পড়লাম, উঠতে উঠতেই সিদ্ধান্ত নিলাম, অসীমার ওপর নজর রাখতে হবে। খুবই সতর্ক নজর রাখতে হবে। তার মানসিকতা এখন স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই।
বেরিয়ে আসবার মুখে ফটকের কাছে একজন তানপুরাধারী লোক আমার পথ আটকাল।
দাদা! আমি হাল ছাড়িনি।
প্রথমটায় চিনতে পারিনি। মস্ত বাবরি চুল, গালে মাইকেলের মতো জুলপি, পরনে চুপ্ত পায়জামা আর গায়ে দারুণ চিকনের কাজ করা পাঞ্জাবি। একটু ঠাহর করে দেখে তবে গন্ধর্বকে চিনতে হল।
আপনা থেকেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল। বললাম, না গন্ধর্ব, হাল ছাড়াটা ঠিকও হবে না। লেগে থাকো। গান কেমন হচ্ছে?
দারুণ! আজকাল-কথা পর্যন্ত গান হয়ে বেরোতে চায়।
বাঃ! আর নাচ?
দুর্দান্ত। আজকাল আমার হাঁটাচলায় পর্যন্ত নাচের ছন্দ।
তোমার হবে গন্ধর্ব।
আপনার আশীর্বাদ।-বলে গন্ধব আমার পায়ের ধুলো নিয়ে বলে, রুমার সঙ্গে আসানসোলের একটা ফাংশনে দেখা হয়েছিল।
তাই নাকি? কেমন বুঝলে?
পাত্তা দিচ্ছে না।
একদম না?
না, তবে আড়ে আড়ে দেখছে বলে মনে হল।
তুমিও লক্ষ রেখো, রুমা পাকাল মাছের মতো পিছল মেয়ে।
লক্ষ রাখার সময় কোথায়? খুব ভোরে গলা সাধি। সকালে যোগব্যায়ামের ক্লাসে যাই। দুপুরে কলেজ। বিকেলে জিমনাসিয়াম। সন্ধেবেলায় নাচের প্র্যাকটিস। ঠাসা প্রোগ্রাম।
আমি সভয়ে বলি, তুমি কি রুমাকে ভুলে যাচ্ছ গন্ধর্ব?
গন্ধর্ব একটু লজ্জা পেয়ে জিব কেটে বলে, তা নয়। তবে আগের মতো সব সময়ে রুমাকে নিয়ে ভাবার মতো সময় হয় না।
কিন্তু মনে পড়ে তো?
একটু-আধটু কি আর পড়ে না।
আমি অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বলি, বিরহের ভাবটা কেটে যাচ্ছে না তো গন্ধর্ব?
গন্ধর্ব আমতা আমতা করে বলে, তা কাটছেনা। তবে আগের মতো তীব্রতা নেই।
সর্বনাশ! গন্ধর্বের কথা শুনে ও হাবভাব দেখে প্রায় মাথায় হাত দেওয়ার অবস্থা হয় আমার। কুমার বিরহ যদি ও হজম করে বসে থাকে তা হলে হয় রুমাকে অন্যপাত্র দেখতে হবে, নয়তো পাকাপাকিভাবেই আমার কাঁধে ভর করতে হবে। কোনওটাই অভিপ্রেত নয়। আমি ভীষণ উদ্বেগে ওর হাত দুটো ধরে ফেলার চেষ্টা করি। তবে ওর এক হাতে তানপুরা থাকার জন্য মোটে একটা হাতই নাগালে আসে আমার, অতি করুশ স্বরে আমি প্রশ্ন করি, গন্ধর্ব, রুমার জন্য তোমার বিরহের তীব্রতা কেন কমে যাচ্ছে? রুমাকে কি সুন্দর বলে মনে হয় না তোমার? বিবাহিত জীবনের স্মৃতিও কি তোমাকে হন্ট করে না?
গন্ধর্ব খুবই লজ্জা পেয়ে বলে, না না, ওসব ঠিকই আছে। তবে বিরহটা একটু ভোতা হয়ে গেছে বটে। আমার মনে হয় দাদা, দুনিয়ার অধিকাংশ বিরহের গল্পই বোগাস। ঠিক মতো ব্যায়াম করলে, গানটান গাইলে বা নাচলে এবং আসন করলে বেশিরভাগ বিরহই কেটে যেতে থাকে।
আমি তার সবল পেশিবহুল হাতখানা জড়িয়ে ধরে রেখেই মিনতির স্বরে বলি, তা হলে তুমি ব্যায়াম বা আসন কমিয়ে দাও গন্ধর্ব, অত নাচগানেরই বা দরকার কী পুরুষমানুষের?
গন্ধর্ব ম্লান একটু হেসে বলে, তা আর হয় না দাদা। ব্যায়াম আমার চোখের সামনে থেকে একটা কূপমণ্ডুকতার পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। নাচ আর গানখুলে দিয়েছে অন্য এক জগতের দরজা, জীবনটা কী যে ভাল লাগে আজকাল। পৃথিবীকে কত সুন্দর লাগে।
রুমাকে ছাড়াও?- করুণতর স্বরে আমি জিজ্ঞেস করি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গন্ধর্ব বলে, রুমাকে ছাড়াও।
কিন্তু এ তো ভাল কথা নয় গন্ধর্ব!
কিন্তু এ পথ আপনিই দেখিয়েছিলেন দাদা। আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। ব্যায়াম, নাচ বা গানে বিরহের ব্যথা সত্যিই কমে যায় বলে যদি জানতাম তা হলে কি আর সেই পথ দেখাতাম গন্ধর্বকে? মনে হচ্ছে, আমার অভ্যন্তরে স্থাপিত ক্যালকুলেটর মেশিনটা এই প্রথম একটা ঠিকে ভুল করে ফেলেছে।
আশপাশ দিয়ে গান ও নাচের ক্লাসের মেয়েরা যাচ্ছে। বেশ সুন্দরী সব মেয়ে। যেতে যেতে গন্ধর্বের দিকে তাকিয়ে যাচ্ছে। হাসছেও কেউ কেউ চেনার হাসি। আমি তাদের চোখে গর্কে প্রতি একধরনের সপ্রশংস গুণমুগ্ধতার ভাব লক্ষ করে শিউরে উঠি। ব্যায়াম করে গন্ধর্বর চেহারা খুলেছে। গানও বোধহয় সে খুবই ভাল গাইছে আজকাল। নাচও হয়তো মন্দ নাচছে না। মেয়েরা যদি গন্ধর্বকে পাত্তা দিতে থাকে তবে বোকা এবং আহাম্মক রুমাটা তো একেবারেই বেপাত্তা হয়ে যাবে।
কথা বলতে বলতেই একটি সুন্দরী মেয়ে এসে গন্ধর্বকে প্রায় হাত ধরে টেনে নিয়ে ভিতরে চলে গেল।
খুবই বেকুবের মতো আমি বাসায় ফিরে আসি এবং ভাবতে থাকি।
.
আকাশ ঘনঘোর মেঘে আচ্ছন্নই ছিল। হঠাৎ বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামল। অঝোর বৃষ্টি। আমার চিন্তা রুমা থেকে দাঁড় বদল করে বৃষ্টির ঘরে গিয়ে বসল। বৃষ্টির লক্ষণ ভাল নয়। বন্যা হবেই। হবে কেন, বন্যা শুরুও হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। গাঁ গঞ্জে কিছু কিছু নিচু জায়গা ডুবে যাওয়ায় ছোটখাটো ইভ্যাকুয়েশনও শুরু হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই স্কুল কলেজ বন্যার জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। বন্যার্তরা এসে ভিড় করবে সেখানে। একারি রিলিফ পৌঁছোতে দেরি হবে আর তা করতে জনগণের নেতারা ছিঁড়ে খাবে প্রশাসনকে। তখন অবশ্যম্ভাবী ডাক পড়বে আমার। আমি সেজন্য প্রস্তুত আছি। আমার কাছে গম, চাল, চিনি, জামাকাপড় সবই মজুত আছে রিলিফের জন্য। তবু একটু খিচ থেকেই যাচ্ছে। রিলিফ নিয়ে গোলমাল বেঁধেছিল গেলবারের আগেরবার। সরকারি গুদাম লুট হয়েছিল অধরের নেতৃত্বে। আমার ক্যালকুলেটর বলছে, নেতৃত্ব অধর এবারও দেবে। তবে এবার আর সরকারি গুদাম নয়। তার লক্ষ্য হবে আমার নিজস্ব গুদাম।