লোকটা হাফাতে হাফাতেই বলল, আরে সাতসকালেই জহরবাবু যে!
প্রতিমাকে নিয়ে এলাম। আপনি বলেছিলেন একবার নিয়ে আসতে।
ভালই করেছেন। ঘরে গিয়ে বন। আমি ধরাচূড়া ছেড়ে আসছি। বলেই লোকটা আমার দিকে চেয়ে চোখ টিপে বলল, তুমিও যাও। কমপিটিটারটিকে ভাল করে মাপজোক করে দেখো। হাই কমপিটিশন।
লোকটা দৌড়োত দৌড়োতে ভিতরে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল।
না, স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি পারিজাত নামক এই ধনতান্ত্রিক, শ্রেণিশত্রু শোষক ও উচ্চাভিলাষী লোকটিকে আমি তেমন অপছন্দ করতে পারছি না। লোকটি পাজি সন্দেহ নেই। শয়তান তো বটেই। অসাধুও নিশ্চয়ই। তবু লোকটার মধ্যে বেঁচে থাকার একটা স্পন্দন আছে। সেই স্পন্দন টের পাওয়া যায়।
জহরবাবু হাত কচলে বললেন, আপনি কি ওঁর কেউ হন?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না।
একসঙ্গে প্রাতঃভ্রমণ করছিলেন। দেখে মনে হল খুব ঘনিষ্ঠ।
আমিও যে চাকরিটার একজন উমেদার সেটা ওঁকে বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে না পেরে একটু দোনোমোনো করলাম। তবে লুকিয়ে লাভও নেই। বলে দিলেই বরং ল্যাঠা চুকে যায়। তাই একটু হেসে বললাম, প্রাতঃভ্রমণ করছিলাম না। দৌড়োতে দৌড়োতে উনি আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন।
বলেন কী! কীসের ইন্টারভিউ?
শিবপ্রসাদ স্কুলে অঙ্কের মাস্টারির।
ওঃ। বলে বিনীত, অমায়িক ও হাস্যময় জহরবাবু সহসা ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলেন।
আমিও চাকরির ক্যান্ডিডেট জেনে প্রতিমা চকিতে আমার দিকে একটু দৃকপাত করল। সুযোগ পেলে সেও হয়তো তার এই কমপিটিটারকে একটু মাপজোক করত, কিন্তু জহরবাবু মেয়েকে সেই সুযোগ দিলেন না। অত্যন্ত বিরক্ত মুখে তিনি মেয়েকে চল, চল, বসিগে। যত সব উটকো ঝামেলা… বলে প্রায় হাত ধরে টেনে বাইরের ঘরে ঢুকে পড়লেন। লক্ষ করলাম, জহরবাবু মাকে মাঝে ঘর থেকে খুনির চোখে আমাকে দেখছেন এবং মেয়ের সঙ্গে অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে নিচু স্বরে একটা জরুরি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। আলোচ্য বিষয় যে আমি তাতে সন্দেহ নেই।
বিপজ্জনক ঘরটিতে আর ঢুকলাম না। দৌড়োনোর পর আমার শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছিল। আমি সিংহীদের বাগানটায় পায়চারি করতে করতে পাখির ডাক শুনতে লাগলাম।
প্রায় আধঘণ্টা পর পারিজাত নামল। পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি, ঠোঁটে একটু বেসুরো শিস। আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিচুস্বরে বলল, কমপিটিটারকে দেখলে?
দেখলাম। তবে আলাপ হয়নি।
কী মনে হল? পারবে কমপিটিশনে?
শুধু চোখে দেখেই কি তা বলা যায়?
তা হলে চল। ফেস হার। মুখোমুখি বসে ষ্ট্যাটেজি ঠিক করো। হাই কমপিটিশন।
লোকটা মজার সন্দেহ নেই। আগেই বলেছি লোকটাকে আমি তেমন অপছন্দ করতে পারছি না। কিন্তু প্রতিমার সঙ্গে কমপিটিশনে নামতেও আমার রুচিতে বাঁধছে। আমি চাকরিটার উমেদার শুনে ওর বাবা এমন রিঅ্যাক্ট করল যে, পুরো ব্যাপারটার ওপরেই আমার ঘেন্না ধরে গেছে।
আমি বিরসমুখে বললাম, হাই কপিটি যে তা বেশ টের পাচ্ছি। তবে সেই কমপিটিশনে আমার নামবার ইচ্ছে নেই। চাকরি আপনি ওকেই দিন।
কেন বলো তো? মেয়েটাকে দেখে কি তোমার মন নরম হয়ে গেছে?
আমি একটু রাগের গলায় বলি, মোটেইনয়। আমি ক্যান্ডিডেট শুনে মেয়েটার বাবা আমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে।
লোকটা হাসল। বলল, আরে দূর! তুমি বড় বেশি সেন্টিমেন্টাল। আসলে জহরবাবু খুব সরল লোক। সরল লোকেরা নিজেদের মনের ভাব গোপন করতে পারে না। তোমাকে কী বলেছে?
আমি বললাম, কিছু বলেনি। কিন্তু অপমানজনক ভাবভঙ্গি করেছে।
ওঃ, এই কথা? লোকটা খুব উদারভাবে হেসে বলে, আমি যে সমাজে জন্মেছি এবং বড় হয়েছি সেই সমাজে মিনিমাম গালাগালি কী ছিল জানো? শুয়োরের বাচ্চা। লোকের সঙ্গে লোকের আন্ডারস্ট্যান্ডিং শুরুই হত শুয়োরের বাচ্চা দিয়ে। সেই থেকেই অপমান-টপমানের বোধ আমার নষ্ট হয়ে গেছে। অপমানবোধ থাকা মানেই একটা ঠা, ওটা যত শিগগির চুকিয়ে ফেলতে পারো ততই মঙ্গল।
আমি তো আপনার সমাজে মানুষ হইনি।
সেই জন্যই তো বলছিলাম তুমি যথেষ্ট গরিবনও। এসো, এসো, ছেলেমানুষি কোরো না।
বেশ গম্ভীর মুখে এবং যথেষ্ট অনিচ্ছার সঙ্গে আমি লোকটার পিছু পিছু ঘরে ঢুকি। জহরবাবু তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, ঠিক যেভাবে ক্লাসে মাস্টারমশাই ঢুকলে ছাত্ররা উঠে দাঁড়ায়। অবিকল মাস্টারমশাইয়ের গলায় লেকটা জহরবাবুকে বলল, বসুন, বসুন।
জহরবাবু বসলেন। আমার দিকে না তাকানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করছিলেন তিনি। কিন্তু কৌতূহল যাবে কোথায়? কাজেই মাঝে মাঝে আমার চোখে চোখ পড়ে যাচ্ছে। পরিষ্কার খুনির চোখ। প্রতিমার চোখেও যথেষ্ট অনিশ্চয়তা, সংশয় ও দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। আমি ভারী অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম।
জহরবাবু খুব বিগলিত মুখে লোকটাকে বলতে লাগলেন, আপনাকে বহুদিন ধরেই জীবনীটা লিখে ফেলতে বলছি, একদম গা করছেনা।
লোকটা উদাস গলায় বলে, কী হবে লিখে?
জহরবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, হবে হবে। আমার মতো গরিবরা দেশের সর্বহারারা আপনার জীবনী পড়ে লড়াই করতে শিখবে। আশা পাবে, ভরসা পাবে, শক্তি পাবে।
আমার তো অত সময় নেই।
জহরবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, তা জানি। আর সেইজন্যই প্রতিমাকে নিয়ে এলাম, ওর হাতের লেখা খুবই সুন্দর। গোটা গোটা ছাপার অক্ষরের মতো, বানান-টানান ভুল করে না, লেখেও তাড়াতাড়ি। তাই বলছিলাম, ইস্কুলের কাজটুকু করেই চলে আসবেন। আপনি নিজের জীবনের কথা বলে যানে, ও বসে বসে ডিকটেশন নেবে।