উনি বাগানেই জগিং করছেন।
এই বাগানেই?
হ্যাঁ, কিন্তু এখন দেখা হবে না।
দারোয়ানরা যদিও আমার প্রায় সমশ্রেণির লোক বু কেন জানি এই শ্রেণিটাকে আমি পছন্দ করি না। দারোয়ান মানেই তো বড়লোকের ধনমানের প্রহরী। তার মানে কর্তাভজা। মালিক হাসলে এরাও হাসে, মালিক গম্ভীর হলে এদের মন খারাপ হয়ে যায়।
আমি নির্বিকার মুখে বললাম, উনি আমার আত্মীয়।
লোকটা খুব ইমপ্রেসড হল না। বড়লোকদের গরিব আত্মীয় থাকতেই পারে, কিন্তু তাদের বেশি লাই দেওয়ার নিয়ম নেই। আমার আকার এবং প্রকার লোকটার পছন্দও হচ্ছিল না। বলল, অপেক্ষা করুন। উনি এসে যাবেন।
লোকটা আবার কুঞ্জবনে ফিরে গিয়ে লুকিয়ে নজর রাখতে লাগল।
সিংহীদের বাগানটা বিরাট। হেসেখেলে বিচারেকহবে। আমি পায়ে পায়ে ঘাসজমি ধরে হটতে লাগলাম।
প্রথম দর্শনে মনে হয়েছিল, সিংহীদের বাগান বা বাড়ির কোনওরকম সংস্কারই বুঝি পারিজাতবাবু করেননি। কিন্তু তা ঠিক নয়। অন্তত একটা সংস্কার তিনি করেছেন। সংস্কার কিংবা সংযোজন। বাগানের চারধারে পাঁচিল ঘেঁষে একটা সরু মোরামের রাস্তা তিনি বানিয়েছেন। সম্ভবত জগিং করার জন্যই।
ধৈর্য ধরে সেই মোরামের রাস্তার ধারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেই লোকটাকে দেখা গেল। পিছনের পুকুরের ধারে কলাকোপের পাশ দিয়ে বাঁকু নিয়ে লোকটা এগিয়ে আসছিল। সাদা হাফ প্যান্ট আর তোয়ালের গেঞ্জি পরা, পায়ে কেডস। কেশ পাকানো শক্ত চেহারা। সন্দেহ নেই লোকটা স্বাস্থ্যসচেন। তা হবে নাই বা কেন? দেদার টাকা, দেদার ভোগ্যবস্তু, দেদার স্তাবক। এত সব ভোগ করতে হলে স্বাস্থ্য তো চাই-ই।
লোকটা কাছাকাছি আসতেই আমি মোরামের রাস্তায় উঠে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পথ আটকালাম।
কিন্তু লোকটা ভারী একয়ে। দাড়িয়াবা খেলার খেলুড়ির মতো সাঁ করে আমাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল এবং হাফধরা গলায় পেঁচাল, চলে আসুন। রান বয়, রান।
বুঝলাম এই স্বাস্থ্য-পাগল, দৌড়-মাতাল লোকটাকেনাগালে পেতে হলে ওটাই একমাত্র উপায়। কী যেন হয়ে গেল আমার মধ্যে। বোধহয় সেটা সাময়িক পাগলামিই। আমি লোটার পিছু পিছু দৌড়তে লাগলাম।
অবশ্য জগিং জিনিসটা ঠিক দৌড় নয়। দৌড় একহটার মাঝামাঝি। দৌড়-পায়ে হাঁটা আর কি।
লোকটা ঘাড় বেঁকিয়ে আমাকে একবার দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী নাম?
অভিজিৎ গাঙ্গুলি।
কী দরকার?
ইস্কুলের অঙ্কের ভেকেলিটার জন্য অসীমা দিদিমণি আমাকে পাঠিয়েছেন।
ও হোঃ, তুমিই অসীমার লোক তা হলে?
হ্যাঁ।
অসীমা বলেছিল আমাকে। মাস্টারি করতে চাও কেন?
চাকরি দরকার তাই।
এই অল্প বয়সে মাস্টারি করতে ভাল লাগবে।
আর কী করব?
মাস্টারির চাকরিতে অ্যাডভেঞ্চার নেই, থ্রিল নেই, টাকা নেই।
জানি।
অন্য কিছু করতে ইচ্ছে হয় না?
আর কী?
বিপ্লব করো, তছনছ করো, ওলটপালট করে দাও সব কিছু।
স্কোপ নেই। পুলিশে ধরবে।
ধরুক না। সেটাও তো একটা অভিজ্ঞতা।
আমার বাড়িতে বড় অভাব।
কীরকম অভাব?
খুব অভাব।
ভাতের বদলে কখনও আটাগোলা খেয়েছ?
না তো?
ঘাস খেয়েছ কখনও?
না।
মেটে আলু খেতে কীরকম হয় জানো?
না।
কাপড় নেই বলে কোনওদিন গায়ে মাদুর জড়িয়ে লজ্জা নিবারণ করতে হয়েছে?
না।
খড়ের বিছানায় শুয়েছ কখনও?
না।
তা হলে কেমন অভাব তোমাদের?
এ ছাড়াও তো অভাব আছে।
তুমি দারিদ্র্যের স্বরূপই এখনও দেখোনি।
আপনি দেখেছেন?
আমি দারিদ্র্যসীমার ওপারের লোক। এক্কেরের শেকড়ের কাছাকাছি থেকে উঠে আসতে হয়েছে। বড় কষ্ট।
আপনি হাঁফাচ্ছেন। এবার থামুন।
আরও দুরাউন্ড। তারপর থাম। ভেবো না আমি হাঁফিয়ে পড়েছি।
কিন্তু আপনি তো হাঁকাচ্ছেন।
ওটা কিছু নয়। দৌড়োতে তোমার কেমন লাগে?
ভাল নয়। আমি বহুকাল দৌড়োইনি।
আর আমি চিরটাকাল কেবল দৌড়োচ্ছি।
তাই নাকি? দৌড়োচ্ছন কেন?
দৌড়ে আসলে পালাচ্ছি।
আমি অবাক হয়ে বললাম, পালাচ্ছেন কেন?
পালাচ্ছি দারিদ্র্য থেকে, ক্ষুদ্রতা থেকে। রানিং বিয়ন্ড টাইম, বিয়ন্ড পভারটি, বিয়ভ এভরিবডি এলস। বুঝলে?
না, ভাল বুঝলাম না।
তুমি যথেষ্ট গরিব নও। যথার্থ গরিবও নও। হলে বুঝতে।
পালানোই কি গরিবের ধর্ম?
গরিবদের কোনও ধর্ম নেই, কোনও নিয়ম নেই। কেউ পালায়, কেউ নেতিয়ে পড়ে থাকে, কেউ রুখে উঠতে চায়।
সুন্দর একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় এসে পড়িআমরা। বন্য একটি গোলাপ গাছের ডাল আমার জামা টেনে ধরে এবং ছেড়ে দেয়। লোকটাকে পিছন থেকে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়ার একটা লোভ সংবরণ করে আমি বললাম, আপনি কি পলাতক।
লোকটা ঘাড় বেঁকিয়ে আর একবার আমাকে দেখে বলল, সামনে একটা নালা আছে। সাবধান।
নালাটা আমরা দুজনেই সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করার পর লোকটা বলে, আমি দৌড়োতে ভালবাসি। ছেলেবেলা থেকেই আমার ইচ্ছে, দৌড়োতে দৌড়োতে নিজেকেও ছাড়িয়ে যাই। বুঝলে?
না। এসব বোধহয় দার্শনিক কথাবার্তা!
লোকটা উদাস গলায় বলল, তা বলতে পারো। দানিকতা তোমার ভাল লাগে না?
লাগে। তবে উদ্ভট দার্শনিকতা নয়।
উদ্ভট হবে কেন? বরং খুব সাধারণ দার্শনিকতা।
কীরকম?
নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মানে গ্রেট সাকসেসেস অ্যান্ড গ্রেটার সাকসেসেস। নিজের যতটা সামর্থ্য আছে বলে তুমি ভাবো তার চেয়েও ঢের বেশি সামর্থ্য অর্জন করতে থাকাই হচ্ছে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া।
আমি খুব সাবধানে একটা ফুলগাছের কাঁটাওলা ডাল এড়িয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে বললাম, তাও বুঝলাম না।