গাড়িবারান্দার তলায় সাইকেল থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠলাম। কেউ কোথাও নেই। কোনও শব্দও শোনা যাচ্ছে না। শুধু ভিতরবাড়িতে কুকুরের গমগমে গলা আর একবার শোনা গেল।
বড়লোকদের মুখোমুখি হতে আমার কোনও অস্বস্তি কাজ করে না। কারণ আমি এ দেশের বড়লোকদের আকণ্ঠ ঘৃণা করি। একটু নেড়েচেড়ে দেখার জন্য পারিজাতবাবু যে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন এতে আমি মজাই পাচ্ছি। আমি ওর সামনে অবশ্যই ভাল মানুষ সেজে থাকা এবং শিক্ষকোচিত গুড়ি গুডি আচরণ করব। কিন্তু লোকটা জানবেও না, আমাকে চাকরি দেওয়া মানে নিজের চেয়ারের নীচে একটি টাইম বোমা স্থাপন করা। চাকরি পেলে আমি ধৈর্য ধরে কনফার্মেশন পর্যন্ত অপেক্ষা করব। আর তারপর আমার যাবতীয় শানানো ঘৃণা ও আক্রোশ নানা আন্দোলন, বিক্ষোভ ইত্যাদি হয়ে ফেটে পড়বে। শিবপ্রসাদ হাই স্কুলে গণ্ডগোল চলছে, আমি জানি। কীরকম গণ্ডগোল তা জানি না। আর গণেশকাকার কাছে শুনেছি, পারিজাত লোক ভাল নয়। দাদুও সেই কথাই বলেন। সুতরাং আমার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা মোটামুটি ঠিকই হয়ে গেছে।
সদর দরজায় খানিকক্ষণ কড়া নাড়লাম। দরজা হাট করে খোলা, কিন্তু লোক নেই। আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কী করার থাকতে পারে?
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক চেয়ে দেখতে লাগলাম। বাগানের দক্ষিণ দিকে একটা দোলনা ছিল। লোহার স্ট্যান্ডে লাগানো শেকলের দোলনা। ছেলেবেলায় অনেক চড়েছি সেটায়। এখন আর দোলনাটা নেই। পাথরে তৈরি একটা ছোট্ট ফোয়ারা ছিল গাড়িবারান্দার সামনেই। সেটা আছে বটে, কিন্তু গতানো গাছে এমন ঢেকে গেছে যে, বোঝাই যায় না। উত্তর দিকে একটা কাশীর পেয়ারাগাছ ছিল। কিন্তু বারান্দা থেকে বোঝা গেল না, গাছটা আছে কি নেই। কারণ ওদিকটায় আরও বড় বড় গাছ কয়েকটা হয়েছে।
যুবকের মতো খানিকক্ষণ হা করে এইসব দেখতে দেখতে হঠাৎ পিছনে একটা মৃদু চটির শব্দে মুখ ঘোরালাম। খুব চমকিলি চেহারার একটা মেয়ে। বেশ চটক আছে চেহারায়, যেমনটা বড়লোকদের থাকেই। জন্মগত চেহারা তেমন দেখনসই না হলেও বড়লোকের মেয়েরা সেটাকেই মেজে ঘসে কতটা সুন্দর করে তুলতে পারে।
মেয়েটা আমার দিকে খুব ভ্রু কুঁচকে এবং অবহেলার দৃষ্টিতে তাকাল বলে আমার মনে হল। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না। বারান্দা পর্যন্ত এলও না মেয়েটা। বাইরের হলঘর থেকে ডানহাতি আর একটা ঘরে গিয়ে ঢুকল।
আমি একটু বেশি সকালে পৌঁছে গেছি। আর একটু পরে আসাই বোধহয় উচিত ছিল। কিন্তু এরকম হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকাটাও আমার ভাল লাগার কথা নয়।
আমি সোজা হলঘরে ঢুকে পড়লাম এবং মেয়েটা যে ঘরে ঢুকেছে সেই ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললাম, শুনছেন?
মেয়েটা একটা ডেসকের ড্রয়ার খুলে নিচু হয়ে কিছু একটা দেখছিল। সেই অবস্থাতেই আমার দিকে একটা তীক্ষ্ণ চাউনি ছুঁড়ে দিয়ে বলল, দাদা এখনও ফেরেনি। বারান্দায় বেঞ্চ আছে, অপেক্ষা করুন।
আমার একটু রাগ হল। তা গরিবদের তো চট করে রাগ হয়েই থাকে। সেটা চাপা দিয়ে বললাম, উনি কোথায় গেছেন?
মর্নিং ওয়াক করতে।
কখন ফিরবেন তার কি কোনও ঠিক নেই?
আমি অত জানি না। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
মেয়েটার কথাবার্তা অভদ্র, আচরণে অহংকার। আমি বললাম, দারোয়ানকে তো দেখলাম না।
আছে। খুঁজে দেখুন।
মেয়েটা যা খুঁজছিল তা বোধহয় পেয়ে গেল। সটান এগিয়ে এসে আমার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একটা বেশ সুগন্ধ পেলাম তার গা থেকে। নাভির নীচে পরা শাড়ি, খুব সংক্ষিপ্ত ব্লাউজে মেয়েটিকে বেশ দেখাল। আমাকে একটু তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করল বটে, কিন্তু বউনিটা খুব খারাপ হয়েছে বলে মনে হল না আমার। সকালবেলাতেই একটা সুন্দর মুখ বা একটা সুন্দর ফিগার দেখতে পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার।
ভিতরে ভিতরে সবসময়ে এক ধরনের ফ্রাষ্ট্রেশন কাজ করে বলেই বোধহয় আমি আজকাল মেয়েদের নিয়ে বেশি কল্পনা করি না। পারুলের সঙ্গে একটা প্রেম-ট্রেম ঘটেনি আমার। প্রেম-ট্রেম করেও তো লাভ নেই। বেকার মানুষ, বাড়িতে হাঁড়ির হাল, সুতরাং একটা মেয়েকে তুলে আনতে তাকেও কষ্ট দেওয়া, নিজেরাও কষ্ট পাওয়া। তবে প্রেম না করলেও কোনও মেয়ে আমাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে আজও মন খিঁচড়ে যায়। বহুদিন বাদে এই মেয়েটা আমার মনে একটা খিচ ধরাল। তবু বউনিটা খারাপ হয়নি।
আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়িবারান্দার তলায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অগত্যা আমার সাইকেলের বেলটা ক্রিং ক্রিং করে বাজাতে লাগলাম। এভাবে যদি খানিকটা ডিসটার্ব করা যায় এদের এক নিজের উপস্থিতির জানান দেওয়া যায়।
কাজ হল। সিংহীদের বাগানে কয়েকটা কুঞ্জবন আছে। তার ভিতরে লোহার বেঞ্চি পাতা বড়লোকদের কত খেয়ালই না থাকে। এরকমই একটা কুঞ্জবন থেকে হঠাৎ খাকি পোশাক পর একটা লোক বেরিয়ে আমার দিকে আসতে লাগল।
লোকটা দারোয়ান সন্দেহ নেই। বুঝলাম, পারিজাতবাবুর বাগানে গোরু ছাগল ঢোকে না কেন প্রকাশ্যে দারোয়ান না থাকলেও আড়ালে বসে নজরদারি করার লোক ঠিকই আছে।
লোকটা আমার কাছে এসে বলল, কাকে চাইছেন?
পারিজাতবাবু কোথায়?
লোকটা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, উনি এখন জগিং করছেন। আপনি একটু পরে আসুন।
কখন আসবেন তার কিছু ঠিক আছে?