দাদু দরজা খুলে দিলেন মুখে বিরক্তি নিয়ে।
ঘরে ঢুকতেই বললেন, এখানে কেরোসিন পাওয়া যায় না। বাতিটাতি বেশি জ্বেলল না। রাতেও কি ওবাড়ি খাবে?
আমি সামান্য একটু ভিজেছি। রুমালে মাথা মুছতে মুছতে বললাম, এখন তো সবে সন্ধে। দেখা যাক।
পারুলের মা এসেছিল। বলে গেল তুমি এলেই যেন পাঠিয়ে দিই।
আচ্ছা। দুপুরে একটু ঘুম হয়েছে?
আমার? না, আমার আর ঘুম কই?
জামাকাপড় পাল্টে আমি চৌকিতে বসি। টিনের চালে বৃষ্টির কান ঝালাপালা শব্দ। এক সময়ে হয়তো এই শব্দ আমার প্রিয় ছিল। কিন্তু এখন নেই। এখন ভয় করে। মনে হয়, বুঝি সব ভেঙে পড়ে যাবে।
একটু চায়ের জন্য ভিতরটা আঁকুপাঁকু করছে। কিন্তু দাদুর চায়ের কোনও পাট নেই। পারুলদের বাড়ি গেলে হয়। কিন্তু এই বৃষ্টিতে বেরোলেই ভিজে যাব।
চুপচাপ শুয়ে চোখ বুজে রইলাম। চোখ বুজতেই অসীমা দিদিমণির মুখটা মনে পড়ল। কীসের এত দুঃখ ভদ্রমহিলার? যে লোকটা ওকে বিয়ে করবে সেই পারিজাতই বা কেমন লোক? শুনেছি, লোকটার মেলা টাকা, অনেক ক্ষমতা! সে কেন একে বিয়ে করতে চায়?
হঠাৎ চড়াক করে আর একটা কথা মনে পড়ে গেল। আমাদের ভিটে কিনতে যে লোকটা এসেছিল সেনা পারিজাতবাবুরই লোক।
আমি উঠে দাদুর ঘরে গেলাম।
দাদু একটা কাঁথা চাপা দিয়ে বসে আছেন। ঘরটা অন্ধকার। একটা সরু মোম জ্বলছে কুলুঙ্গিতে। সেই আলোয় দাদু একটা কাগজের পুরিয়া খুলে কী যেন দেখার চেষ্টা করছেন মন দিয়ে।
আচ্ছা দাদু, এই জমিটা যে কিনতে চায় তার নাম পারিজাত না?
হ্যাঁ। কেন?
লোকটা শিবপ্রসাদ স্কুলের সেক্রেটারি।
তা হবে।
সেই স্কুলেই আমার চাকরি হওয়ার কথা চলছে।
দাদু তার পুরিয়া থেকে চোখ না তুলেই বলেন, তাই নাকি? চাকরি কি হয়ে গেছে?
না, কথা চলছে।
দাদু পুরিয়াটার ওপর আরও ঝুঁকে পড়ে বললেন, আগের দিনে আর কোনও চাকরি না হোক মাস্টারিটা পাওয়া যেত। আজকাল শুনি, মাস্টারি পেতেও নাকি অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।
তুমি কি জমিটা ওকে বেচবে বলে কথা দিয়েছ?
না। তুমিই তো বিকেলে বলে গেলে, এখানে থেকে মাস্টারি করতে তোমার সুবিধে হবে।
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলি, বলেছিলাম। কিন্তু তখন জানতাম না যে, পারিজাতবাবুই সেক্রেটারি।
দাদু পুরিয়া থেকে চোখ তুলে আমার দিকে চেয়ে বললেন, তাতে তফাতটা কী হল?
ভাবছিলাম পারিজাতবাবুর সঙ্গে একটা ডিল করা যায় কি না।
কীসের ডিল?
ধরো যদি বলা যায় যে, জমিটা তুমি ওঁকেই বেচবে যদি চাকরিটা আমার হয়।
দাদুর চোখে মোমবাতির আলোতেও সন্দেহের ছায়া দেখতে পেলাম। বললেন, তাতে আমার লাভ কী? তোমাকে চাকরি দিলে ও কি বাজার-দরে জমি কিনবে ভেবেছ? এক মোচড়ে দাম অর্ধেকে নামিয়ে দেবে।
তা বটে। আমি হতাশ গলায় বলি।
পারিজাতকে তুমি চেনো না। বরং কাউকে মুরুব্বি ধরো।
ধরাধরি করতে পারব না। তার চেয়ে বিজনেস ডিল করা অনেক সম্মানজনক।
মাইনে কত দেবে খোঁজ করেছ?
না। তবে আজকাল মাস্টারির মাইনে খারাপ নয়।
কত শুনি।
সাত-আটশো হবে।
দাদু চোখ কপালে তুলে বলেন, বলো কী। মাস্টাররা তো তা হলে জাতে উঠে গেছে।
তা উঠেছে। কিন্তু টাকার দাম পড়ে গেছে দাদু।
দাদু একটু চুপ করে থেকে গালের হরতুকি মাড়িতে চিবোলেন। লালায় অনেকক্ষণ ভিজে হরতুকিটার এতক্ষণে কাদার মতো নরম হয়ে যাওয়ার কথা। চিবোতে চিবোতে বললেন, জমি বেচলে তোমার চাকরি হবে। এ বড় অদ্ভুত ব্যবস্থা। চাকরি না হয় হল, কিন্তু আমি থাকব কোথায়?
বাসা ভাড়া নেব।
ফের ভাড়া বাসা? জন্মে ভাড়াটে থাকিনি বাপু, এই শেষ বয়সে পারব না।
ওরা তো বলেছে, আপনি যতদিন বাঁচবেন ততদিন ঘরটুকু আর কুয়োতলা নেবে না।
সেটা কথার কথা। একবার রেজিস্ট্রি হয়ে গেলে তখন কে কার কড়ি ধারে? লোক-লস্কর নিয়ে এসে পাঁজাকোলা করে তুলে বের করে দিলেই বা মারে কে?
লোকটা কি খারাপ নাকি?
ভাল লোক আর কোথায় পাবে একালে? সব পাজি।
আমি একটু দমে গেলাম। বললাম, চাকরি একটা আমার দরকার দাদু। বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ।
খারাপ তো হবেই। পেটের ভাতের যোগাড় রেখে তার পরই বাবুগিরি করতে তোমাদের কলকাতায় যাওয়া উচিত ছিল। তা তো করলে না। আমি একা মানুষ, জমি-জিরেত সামলাতে পারলাম না। লোকবল থাকলে আজ খেতের ধান কটা গোলায় ভোলা যেত।
পুরনো তর্ক। এ নিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তবে একসময়ে আমি একটা উগ্র রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে একটা জিনিস শিখেছি। ভূমির সঙ্গে, কর্ষণের সঙ্গে যে-মানুষের গভীর সংযোগ নেই সে কখনও দেশকে ভালবাসতে পারে না।
মউডুবিকে এখন আর গ্রাম বলা ঠিক হবে না। শহরের কাছ-ঘেঁষা গঞ্জ। কিন্তু আমি এমন এমন লক্ষ্মীছাড়া গ্রাম দেখেছি যেখানে পানীয় জল নেই, ডাক্তার ওষুধ হেলথ সেন্টার নেই, রাস্তা নেই, খাবার নেই। কিছু লোক ধুকছে আর ধুকছে। অথচ, গোটা দেশটারই শক্তির উৎস ওই গ্রাম, ওইসব কৃষিক্ষেত্র ও গোচারণভূমি। কিন্তু এই আজব রাজনীতির দেশের শাসকরা যে ডালে বসে আছে সেই ডালটিই বে-খেয়ালে কেটে ফেলছে।
আমি আর দেশোদ্ধারের কথা ভাবি না। এখন আমার সম্মানজনক শর্তে একটা চাকরি চাই।
কড়ে আঙুলের চেয়েও সরু এবং মাত্র দুআঙুল লম্বা একটা মোম আমার হাতে দিয়ে দাদু বললেন, জ্বেলে নাও গে। বর্ষার দিন, পোকামাকড় ঘরে ঢোকে। একটু দেখেশুনে নিয়ে ঘরখানা। কেউ থাকে না, সাপখোপ বাসা করেছে কি না তাই বা কে জানে!