জানালা দিয়ে আমি আরও খানিকক্ষণ বৃষ্টি দেখলাম। চমৎকার বৃষ্টি, হিংস্র, আদিম, ভয়ংকর।
সিংহীবাবুদের এই বাড়িটা বেশ বড়সড়। এর স্থাপত্যে নানা জায়গায় বেশ কারুকাজ আছে। অবশ্য সময়ের খাজনাও দিতে হয়েছে বাড়িটাকে। মেঝে ফেটে গেছে জায়গায় জায়গায়। দেয়াল থেকে পলেস্তারা খসে পড়েছে কয়েকটা ঘরে। দোতলায় দুটো ঘরে জল চোয়ায়। আমি সেগুলো মেরামত করিনি। কারণ এই প্রকাণ্ড বাড়িটায় থাকি মাত্র আমরা দুটি ভাইবোন এবং কয়েকজন দাসদাসী ও দুটো কুকুর, আর আছে হাঁস, মুরগি, খাঁচার পাখি ও গোটা দুই জারসি গরু। অন্যান্য বোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা কেউ সুখে, কেউ দুঃখে আছে। আমার দুটি ভাই কলকাতা এবং দিল্লিতে চাকরি করে। সম্পর্ক খুব ক্ষীণ, নেই বললেই হয়।
আমার বোন রুমা যদিও আমার কাছেই থাকে তবু তার সঙ্গেও আমার সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ। প্রায়ই সে কলকাতায় খোঁপা বাঁধতে বা চুল ছাঁটতে বা ফাংশন করতে চলে যায়। যতদূর জানি সে সাইকেল, স্কুটার এবং মোটরগাড়ি চালাতে পারে। স্কুলে পড়ার সময় সে জিমনাস্টিকস করত। ভাল গান গাইতে এবং নাচতেও পারত। দেখতে সে মোটামুটি ভাল, মুখশ্রী তেমন সুন্দর না হলেও ফিগার অসাধারণ। ইদানীং সে কারাটে বা ওই জাতীয় কিছু শিখছে বলে শুনেছি। অতিরিক্ত শরীরচর্চার ফলেই বোধহয় সে তেমন মস্তিষ্কের চর্চা করতে পারেনি। কম্পার্টমেন্টাল হায়ার সেকেন্ডারি টপকেই সে মোটামুটি লেখাপড়া শেষ করে। তারপর সে মন দেয় পুরুষজাতির প্রতি। বলতে নেই পুরুষজাতির মধ্যে প্রবেশ করেই রুমা একটা ঝড় তুলেছিল, তার জনপ্রিয়তায় আমিও চিন্তিত হয়ে পড়ি এবং তাকে ঠারেঠোরে বোঝাতে থাকি যে, মহিলারা সাধারণত একগামিনীই হয়ে থাকে। বহুগামিনী হওয়া মেয়েদের প্রকৃতিবিরুদ্ধ।
ব্যাপারটা রুমাও বুঝতে পারত। তবে কোন পুরুষটি তার উপযুক্ত হবে তা বেছে বার করতে হিমশিম খাচ্ছিল সে। শাড়ির দোকানে ঢুকলে মেয়েদের যে অবস্থা হয় আর কি। কোনওটাই পছন্দ হয় না বা একসঙ্গে অনেকগুলো হয়।
গন্ধর্ব নামটা জনগণের কেমন লাগে আমি জানি না। কিন্তু এই নামের লোকদের আমি সন্দেহের চোখে দেখি। গন্ধর্ব নামটার মধ্যেই একটা ধোঁকাবাজি আছে বলে আমার ধারণা। অবশ্য এ নামের একটা লোককেই আজ অবধি আমি চিনি। রুমা অনেক বেছেগুছে এই গন্ধর্বকেই বিয়ে করেছিল। নামটা যেমনই হোক, গন্ধর্ব ছেলেটা বোধহয় তেমন খারাপ নয়। রোগা, ফরসা ও সুদর্শন এই ছেলেটি ছিল অধ্যাপক। ছিল কেন, এখনও আছে। জাতি হিসেবে অধ্যাপকদেরও আমার বিশেষ পছন্দ হয় না। দেদার ছুটি ভোগ করে করে এরা অল্প দিনেই ভীষণ কুঁড়ে হয়ে পড়ে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা জিনিসটা একদম হারিয়ে ফেলে। বইপোকা হওয়ার ফলে এদের অধিকাংশেরই বাস্তববুদ্ধি কিছু কম হয়ে থাকে। গন্ধর্বর মধ্যে অধ্যাপকোচিত সব অপগুণই ছিল। ফলে বিয়ের দুবছরের মাথায় রুমা তাকে ডিভোর্স করে আমার কাছে ফিরে আসে। শোকে গন্ধর্ব মদ ধরে। মাতাল অবস্থাতেই সে একদিন আমার কাছে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, দাদা আমাকে বাঁচান। রুমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।
রুমাকে আমি জানি। আমাকে সে সামান্যতমও সমীহ করে না। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনও কথা বলতে গেলেই সে আমার দিকে অত্যন্ত শীতল ও কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। রুমা দাদা হিসেবে আমাকে স্বীকার করলেও মানুষ হিসেবে সে আমাকে শ্রদ্ধা করে না তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই। সম্ভবত রুমা আমার উত্থানের গোপন ইতিহাসটিও জানে। তাই রুমাকে আমি ঘটাতে সাহস পাই না। গন্ধর্বর কাতর আবেদনে সাড়া দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে আমি তাকে একটি সুপরামর্শ দিয়ে বলি, গন্ধর্ব, রুমা একটু ফিজিক সেনট্রিক। যাকে শরীর-সর্বস্ব বলা যায় আর কি। হুট করে তোমাকে বিয়ে করে ফেলেছে বটে ঝোঁকের মাথায়, কিন্তু আমি জানি, ওর বিয়ে করা উচিত ছিল কোনও ব্যায়ামবীরকে। যদি রুমার মন পেতে চাও তবে ব্যায়াম করতে থাকো। তোমার, বয়স এমন কিছু হয়নি, এখন শুরু করলেও পারবে।
বাস্তবিকই গন্ধর্ব ব্যায়াম শুরু করে দেয়। একটা জিমনাসিয়ামে ভর্তি হয়ে সে বছর দুই একতানমনপ্রাণে শরীরচর্চা করে যেতে থাকে। ফলও পায় হাতে হাতে। দুবছর বাদে তার ঘাড়ে গর্দানে দিব্যি পেশীবহুল স্বাস্থ্য হয়। ততদিনে অবশ্য রুমার আরও বহু গুণগ্রাহী জুটে গেছে। যে কোনওদিন সে দ্বিতীয় স্বামী নির্বাচন করে বসবে, সেইসময়ে একদিন আমারই প্ররোচনায় গন্ধর্ব এসে হাজির হয় এবং প্রায় জোর করেই রুমাকে তুলে নিয়ে যায়।
আমার ধারণা গন্ধর্বর সেই জোর খাটানোর ব্যাপারটা রুমা বেশ উপভোগ করেছিল। তাই বিশেষ চেঁচামেচি করেনি, সুড়সুড় করেই চলে গিয়েছিল।
কিন্তু দ্বিতীয় দফার বিয়েটা টিকল মাত্র বছরখানেক। গন্ধর্বকে আবার ডিভোর্স করার মামলা ঠুকে ফিরে এসে রুমা আমাকে বলল, গন্ধর্ব ভীষণ আনকালচার্ড, একটা জংলি, ব্লুট।
আমি অবাক হলেও, মুখে কিছু বলার সাহস পেলাম না।
গন্ধর্ব একদিন অপরাধী মুখ করে গোপনে আমার সঙ্গে দেখা করে বলল, দাদা, আজকাল আমার শরীরের সবরকম খিদে বেড়ে গেছে। গায়ের জোরও হয়েছে সাংঘাতিক। ফাইনার সেনসগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। আমার এই শারীরিক তেজ রুমা ঠিক সহ্য করতে পারছিল না। এবার কী করব বলুন!