আমি বিনীতভাবে বললাম, দেশের সব গুদাম থেকেই অল্পবিস্তর চুরি হয়, এমনকী ডিফেন্সের গুদাম থেকেও। ওটা কথা নয়। কথা হল লুট নিয়ে।
শুভ্রাংশু চিন্তিতভাবে বলে, আগের লুটটা আমার আমলে হয়নি। তখন মিস্টার রায় ছিলেন। ঘটনার ডিটেলস জানি না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, আমি জানি।
এখানকার লোকেরা কি একটু হোসটাইল ধরনের?
আমি হাসলাম। বললাম, সাধারণ মানুষেরা কখনওই হোসটাইল নয় সেন সাহেব। তবে তাদের হোসটাইল করে তোলা যায়। এখানে এমন কয়েকজন লোক আছে যারা কাজটা খুব সুন্দর পারে।
তারা কারা?
জানলেই বা তাদের আপনি কী করবেন?
কোনও স্টেপ নেওয়া যায় না?
আমি নিরেট গলায় বললাম, না। কারণ তারা নেতা বা নেতা-স্থানীয় লোক।
ওঃ! খুব হতাশ শানাল শুভ্রাংশুর গলা। বলল, তা হলে অবশ্য কিছু করার নেই।
না। কিছু করার নেই সেন সাহেব। সরকারি মাল জনসাধারণ সুট করবে, এতে কার কী করার আছে? তবে টনাটা যদি ঘটেই যায় তা হলে আপনাকে হয়তো জবাবদিহি করতে হবে, চাকরির ক্ষেত্রেও কনফিডেনসিয়াল রিপোর্টে একটা দাগ থেকে যাবে। আপনি ইয়ং ম্যান।
কিন্তু কিছু করারও তো নেই। আরও ফোর্স চেয়ে পাঠাতে পারি।
তাতে লাভ হবে না।
সেটা জানি। আর কী করব?
ভাবুন সেন সাহেব, ভাবুন, দুর্যোগ আসছে। ডার্ক ডেজ আর অ্যাহেড।
শুভ্রাংশু হতাশ গলায় বলল, এ, সন্ধেটাই মাটি করে দিলেন মশাই। দিব্যি হালাগুল্লা করছিলাম। কেন ঝামেলা মাচালেন বলুন তো?
বৃহত্তর ঝামেলা অ্যাভয়েড করার জন্য।
কিন্তু অ্যাভয়েড করব কী করে তা তো বললেন না।
অত উতলা হবেন না। অনেক কিন্তু আছে। ধরুন বন্যা যদি না হয় বা নেতারা যদি ভুখা জনসাধারণকে না খ্যাপায় তা হলে ঝামেলা হবে না। আমি শুধু বৃষ্টির রকমটা দেখে আগাম আপনাকে সাবধান করে দিলাম।
এমনিতেই তো ফুড ব্যাপারটা সাংঘাতিক সেনসিটিভ। তার ওপর ফ্লাড-পোন এরিয়া। নাঃ, আপনি আমাকে ভাবিয়ে তুললেন, ইলিশটার কোনও টেস্ট পাচ্ছি না আর।
দোষ ইলিশের নয় সেন সাহেব। দোষ আপনার মনের। অত সহজে ঘাবড়ে যান কেন?
ঘাবড়ে যাই সাধে নয়। আমি এফ সি আই-এর লোক নই। সেনট্রাল অ্যাকাউনটসে দিব্যি দশটা-পাঁচটা নিরাপদ চাকরি করতাম। দুম করে কমপিটিটিভ পরীক্ষায় সিলেকটেড হওয়ার পর ফুডে ঠেলে দিল। বিচ্ছিরি ডিপার্টমেন্ট। রোজ ঘেরাও, রোজ লেবার ট্রাবল। অফিসটা একেবারে নরক। ক্লাস ফোর স্টাফদের পর্যন্ত কানো যায় না। তার ওপর যদি গুদাম লুট হয় তো সোনায় সোহাগা। আপনার কী মনে হয়, ফ্লাড কি হবেই?
বৃষ্টির ধরনটা তো সেইরকমই। দুটো নদীর জল ডেনজার লেভেলের ওপরে উঠেছে।
ফ্লাড জিনিসটাকে আমি বড় ভয় পাই।
আমি আবেগমথিত গলায় বললাম, ফ্লাডের আপনি কী জানেন সেনসাহেব? আমার কত কী ভেসে গেছে বন্যায়। খরায় জ্বলে গেছে কত কী। তখন আমারও সব লুটপাট করতে ইচ্ছে করত। আমি, আমরা বড় গরিব ছিলাম।
জানি। আপনার মুখেই শুনেছি।
সেইজন্যই বৃষ্টি দেখলে আমার মেঘদূতের কথা মনে পড়ে না। মনে পড়ে, আমার হাঁপানির রুগি বাবাকে যতবারকাথাকানি দিয়ে ঢাকতে যাচ্ছেন মা, ততবার দেখছেন, সব ভেজা। সপসপে ভেজা। ঘরের মধ্যে অবাধ ঘোলা জল, তাতে কেঁচো, ব্যাং, টোড়া সাপ, উচ্চিংড়ে, কত কী। ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি সেন সাহেব?
না, শুনছি। ভারী প্যাথেটিক।
ভীষণ। আপনার কি কখনও লুটপাট করার ইচ্ছে হয়েছে সেন সাহেব?
না, কখনও নয়।
স্বাভাবিক। আপনি তো কখনও দারিদ্র্যসীমার ওপাশে থাকেননি। ওপাশে যারা থাকে তাদের মধ্যে সর্বদাই ওরকম একটা ইচ্ছে কাজ করে। তবে ভয় পাবেন না। সাধারণত দারিদ্র্যসীমার নীচেকার মানুষেরা নিরীহ, বোকা, সংহতিহীন এবং ভিতু। দাদা বা নেতা গোছের কেউ এসে যদি তাদের ঐক্যবদ্ধ করে বিশেষ একটি লক্ষ্যে চালনা করে তা হলেই বিপদ।
সে তো বটেই। খুব পাশুটে গলায় শুভ্রাংশু বলে।
আমি মোলায়েম গলায় বললাম, জনসাধারণকে ভয়ের কিছু নেই সেন সাহেব, শুধু দাদা বা নেতাদের দিকে নজর রাখুন।
সেই কাজটাই কি খুব সোজা?
না। কোনও কাজই বড় সোজা নয় সেনসাহেব। আমি শুধু সাবধান করে দিচ্ছি। আর কিছু করার নেই আমার। তবে আমার আরও দুটো গুদাম আছে। যদি বিপদ বোঝেন তা হলে নতুন স্টক যা আসবে তা আমার গুদামে তুলে দেবেন।
কোনও রিস্ক নেই তো!
আমি একটু হেসে বললাম, সব কাজেই রিস্ক থাকে সেনসাহেব। তবু যদি রিস্ক অ্যাভয়েড করতে চান তা হলে না হয় আমার লোকজন আর লরি দিয়ে আমি মাল খালাস করিয়ে আনব।
আচ্ছা। ভেবে দেখি।
টেলিফোনটা আমি নামিয়ে রাখি। শুভ্রাংশুকে টেলিফোনে কথাটা বলার উদ্দেশ্য কী তা স্পষ্টভাবে আমিও জানি না। তবে দীর্ঘদিনের অভ্যাসে আমার মনের মধ্যে একটা আশ্চর্য স্বয়ংক্রিয় ক্যালকুলেটর কাজ করে যায়। সেই ক্যালকুলেটর কখনও ভুল করেছে বলে নজির নেই। আমার মন বলছে এবারও আবার এই শহরে এবং আশেপাশে বন্যা হবে। অজস্র মানুষ এসে জড়ো হবে শহরে। ভরে যাবে ইস্কুলবাড়ি, কলেজ, কাছারি, অফিস। যথারীতি রিলিফ আসবে দেরীতে। লোকের মধ্যে ফেনিয়ে উঠবে পুঞ্জীভূত ক্রোধ। কেউ একজন সেই বারুদে খুব দক্ষতার সঙ্গে একটি দেশলাই কাঠির আগুন ধরিয়ে দেবে। গত বছরের আগের বছর এই কাজটি করেছিল অধর।
স্পিরিটেড বলতে যা বোঝায় অধরও অনেকটা তা-ই। কমলা সেনের সঙ্গে তার প্রণয়ঘটিত ব্যাপারটি বাদ দিলে তার আর কোনও বন্ধ বা দুর্বলতা নেই। অধরকে তাই আমি কিছুটা ভয় পাই। আমার ধারণা অধর আমাকে ছোবল দেওয়ার একটা সুযোগ খুঁজছে। বন্যা হলে সে সুযোগ অধর পেয়েও যাবে। এই অঞ্চলে রিলিফের চাল ও গম সাধারণত আমাকেই সাপলাই দিতে দেওয়া হয়। মোটামুটি পাকা চুক্তি। আমার নিজস্ব দুটো গুদাম আছে শহরের এক ধারে। আমার ধারণা অধর এবার সেখানে চড়াও হবে। জনতার ঢেউয়ে ভেসে যাবে দুটো গুদাম। যাক, তাতে ক্ষতি নেই। তার আগেই আমি গুদামের মাল সরিয়ে নেব। তা বলে দরিদ্র, মূর্ধ, বঞ্চিত ভারতবাসীকে হতাশও করব না আমি। তারা যদি লুট করে তো করবে। তবে সুট করবে সরকারি জিনিস যা লুট করার অসাংবিধানিক অধিকার তাদের আছে।