আজ তো করাপশান নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল তোমাদের।
হ্যাঁ, স্কুল ফান্ড এবং অডিট রিপোর্ট নিয়ে সে আলোচনা ভণ্ডুল হয়ে গেছে।
কমলাদির রি-অ্যাকশন কী?
প্রথমে কিছুক্ষণ কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। তারপর যখন ওঁর বিরুদ্ধে খোলাখুলি বলতে লাগল কয়েকজন তখন একদম পাথরের মতো চুপ করে গেলেন। সারাক্ষণ একটিও কথা বলেননি।
আমি অসীমার মুখের দিকে নিবিড় দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলাম। বুঝতে পারছি, অসীমা আজকের মিটিং ভণ্ডুল হওয়ায় খুশি হয়নি। কমলা সেন জব্দ হওয়াতেও আহ্লাদিত হয়নি। অথচ হওয়া উচিত ছিল। আমার মন বলছে, আর কয়েকদিনের মধ্যেই কমলা সেনকে রেজিগনেশন দিতে হবে। সেক্ষেত্রে অসীমার হেডমিসট্রেস হওয়া আটকানোর কেউ নেই। তবু অসীমা খুশি নয়। আশ্চর্য।
আমি মৃদু মেহসিক্ত স্বরে বললাম, তোমার কি শরীর ভাল নেই অসীমা?
কেন বলো তো!
তোমাকে ভাল দেখছি না।
মনটা ভাল নেই। স্কুলটার কী হবে তাই ভাবছি।
কী আর হবে, উঠে যাবে না। ভয় নেই।
তা নয়। কমলাদি চলে গেলে স্কুলটার আর সেই গুডউইল থাকবে না। এই স্কুলের জন্য উনি একসময়ে নিজে বাহান্ন ভরি সোনার গয়না দিয়ে দিয়েছিলেন, সেটা তো জানো।
জানি।
স্কুল স্কুল করে পাগল। এখনও ঘুরে ঘুরে দেখেন কোথাও ঝুল জমছে কি না, কোথাও ঘাস বড় হয়েছে কি না, কোনও বেঞ্চির পেরেক উঠে আছে কি না। ওঁর মতো এরকম আর কে করবে?
আমি নিরীহ মুখ করে বললাম, পৃথিবীতে কেউ তো অপরিহার্য নয়।
অসীমা আমার দিকে চেয়ে ছিল। কিন্তু লক্ষ করলাম ওর দৃষ্টি আমাকে ভেদ করে বহু দুরের এক আভাসিত রহস্যময় অন্ধকারকেই দেখছে বুঝি।
আমি জানি কথা ও নীরবতা এই দুইয়ের আনুপাতিক ও যথাযোগ্য সংমিশ্রণের দ্বারাই মানুষকে প্রভাবিত করতে হয়। কেবল কথা বলে গেলেই হয় না, আবার শুধু চুপ করে থাকলেও হয় না। কখন কথা বলতে হবে এবং কখন নয় তা বোঝা চাই।
পরিস্থিতি বিচার করে আমি বুঝলাম, এখন চুপ করে থাকাটা ঠিক হবে না। তাই আমি খুব মোলায়েম গলায় বললাম, একসময়ে পণ্ডিত নেহরু যখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন আমরা ভাবতাম নেহরু মারা গেলে বুঝি দেশ অচল হয়ে যাবে। কিন্তু তা তো হয়নি। রাশিয়ায় স্ট্যালিনের পরও দেশ চলেছে, মাওকে ছাড়াও চলছে চিন।
অসীমার দৃষ্টি দুর দর্শন থেকে নিবৃত্ত হল না। তবে সে মৃদুকণ্ঠে বলল, কমলাদির জায়গায় আমি হেডমিসট্রেস হলে কেউ আমাকে পছন্দ করবে না।
কথাটা নির্মম সত্যি। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে গেলাম। মুখটা একটু হাসি-হাসি করে বললাম, কমলাদির অবদান তো কম নয়। এতকাল তিনিই তো একচ্ছত্র আধিপত্য করেছেন। কিন্তু আমরা যেমন নেহরুর পর ইন্দিরা গাঁধীকে মেনে নিয়েছি, তেমনি তোমাকেও সবাই একদিন মেনে নেবে।
তুলনাটা অসীমাকে স্পর্শ করল না। খুব সিরিয়াস টাইপের মেয়ে। সহজে ওকে প্রভাবিত করা যায় না। একটু ধরা গলায় বলল, স্কুলকে আমিও ভালবাসি। কিন্তু কমলাদি অন্যরকম। স্কুলটাই ওঁর প্রাণ। আমার তো মনে হয় চাকরি ছাড়লে উনি বেশিদিন বাঁচবেন না।
আমি একটু কঠিন হওয়ার চেষ্টা করে গম্ভীর হয়ে বললাম, আমাদের তো কিছু করার নেই।
জানি।-বলে চুপ করে রইল অসীমা।
আমি অসীমার মনোভাব যে সঠিক বুঝি তাও নয়। কমলা সেন চাকরি ছেড়ে দিলে অসীমা হেডমিস্ট্রেস হবে, কিন্তু ওই লোভনীয় পদ ও নিরঙ্কুশ আধিপত্যের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ওকে আকর্ষণ করে না। কেন করে না তা ভেবে আমি বিস্মিত হতে পারতাম। কিন্তু আমার বিস্ময়বোধটা বিচিত্র ধরনের মানুষ দেখে দেখে লুপ্ত হয়ে গেছে। বিচিত্র, বহুমুখী ও বিটকেল চরিত্রের লোকে দুনিয়াটা ভরা। একজন বিচিত্র মানুষের কথা আমি জানি। খুবই বিচিত্র চরিত্রের লোক। গাঁয়ের কয়েকজন কামার্ত পুরুষ একবার একজন সুন্দরী যুবতীর প্রতি লোভ করেছিল। মেয়েটা যেখানে যেত সেই পথেরই আশেপাশে ঘাপটি মেরে থাকত তারা। মেয়েটা ভ্রূক্ষেপও করত না। লোকগুলো নানা রকম ফাঁদ পেতে পেতে যখন হয়রান হয়ে পড়ল তখন সেই বিচিত্র লোকটি একদিন এসে জুটল তাদের দলে। জিজ্ঞেস করল, তোদের মতলবখানা কী বল তো? লোকগুলো কাচুমাচু হয়ে বলল, ঠাকুর ভাই, ওই মেয়েটা যে আমাদের পাত্তাই দেয় না, তার একটা ব্যবস্থা করে দাও। তুমি তো শুনি বিস্তর লোকের হরেকরকম, সমস্যার সমাধান করে বেড়াও। আমাদের এটুকু করে দাও দেখি। লোকটা বলল, এ আর কথা কী! মেয়েটা পুকুর থেকে কলসিতে জল ভরে ফিরছিল। লোকটা গিয়ে পিছন থেকে ডাক দিল, মা, ওমা। কেমন আছিস মা? মেয়েটা ওই মা ডাকে এমন উজ্জ্বল, এমন আলোকিত, এত লজ্জারুশ হয়ে উঠল যে, বহুগুণ সুন্দর দেখাল তাকে। মিষ্টি হেসে বলল, ভাল আছি বাবা, তুমিও ভাল থেকো। লোকটা একগাল হেসে কামার্ত সেই লোকগুলোর কাছে এসে বলল, দেখলি। ভারী সোজা মেয়েদের বশ করা। একবার মা যদি ডেকে ফেলতে পারিস তাহলেই কেল্লা ফতে। মেয়েটাও বশ হল, ভিতরকার শক্তটাও বশ হল। এরপর থেকে সেই লোকটা বোজ সেই লোকগুলোকে তাড়া দিত, ডাক, মেয়েটাকে মা বলে ডাক। ডেকেই দেখ না, কী হয়। তা সেই লোকগুলো অতিষ্ঠ হয়ে একদিন ডেকেই বসল, মা। আর সেই মা ডাকের সঙ্গে সঙ্গে কাধ থেকে ভূতটা নেমে গেল।
বলতে কী, এইসব বিচিত্র ও বিটকেল লোককে আমি ভয় খাই। কাঁধ থেকে ভূত নামানো আমার উদ্দেশ্য নয়। বরং কাঁধে কিছু কিছু ভূত সর্বদা বসে ঠ্যাং দোলাতে থাকুক। তাতে দুনিয়াটা অনেক স্বাভাবিক ও যুগোপযোগী হয়। হেডমিসট্রেস হওয়ার সম্ভানায় অসীমার আনন্দ না হওয়াটা আমার চোখে ভূতের অভাব বলেই ঠেকল। তবু আমি বিস্মিত হলাম না। কারণ এরকম আমার দেখা আছে।