চতুর্ভুজ একটু হতাশার গলায় বলল, সরকার যে ওদিকে ডেভেলপমেন্ট করবে তা বুড়ো জেনে গেছে।
আমি শান্ত স্বরেই বললাম, এসব খবর কি আর চাপা থাকে? কেউ না কেউ রটাবেই।
চতুর্ভুজ যে ব্যর্থতার গ্লানিতে ভুগহে তা ওর মুখ দেখেই বোঝা যায়। অথচ জমিটা ও কিনবে না, কিনব আমি। তবে ওর দুঃখ কীসের? আমার মনে হয়, অন্য লোকে যদি লটারি পায় তবে মানুষ যে সব সময়ে তাকে হিংসে করে তা নয়। অনেক সময়ে মানুষ সেই লোকটার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে এক ধরনের আত্মরতি করতে থাকে। এও হল তাই। এ জমি কিনে আমি যদি মোটারকম একটা দাও মারতে পারি তবে চতুর্ভুজ খুশি হবে।
কিন্তু মোটারকম দাঁও মারার ব্যাপারটা এখনও অনিশ্চিত। গভর্নমেন্ট যে ঠিক ওই জায়গাতেই ডেভেলপমেন্ট করবে তা পাকাপাকিভাবে স্থির হয়নি। তবে এই অঞ্চলে কিছু কৃষিনির্ভর, শিল্প বা অ্যাগ্রো ইনডাসট্রি গড়ে তোলার একটা কথা চলছে। মউডুবির বঙ্কিম গাঙ্গুলির জমিটা কিনতে পারলেও সেটা আমার পক্ষে একটা জুয়া খেলার সামিলই হবে। যদি শেষ অবধি ওদিকে ডেভেলপমেন্ট না হয় তাহলে টাকাগুলো আটকে রইল। তবে অরিন্দমবাবু এবং অন্যান্য জানবুঝওলা অফিসাররা আমাকে গোপনে জানিয়েছেন, মউডুবিই সেই চিহ্নিত জায়গা।
আমি সহজে হতাশ হই না। কারণ আমি বড় হয়েছি এক মস্ত অন্ধকার বুকের মধ্যে নিয়ে। আমার জীবনটাও নানারকম জুয়া খেলার সাফল্যের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে।
আমি আচমকাই চতুর্ভুজকে জিজ্ঞেস করলাম, নারকোল ডিহাইড্রেট করা যায় না?
চতুর্ভুজ ক্যাবলার মতো মুখ করে বলল, তা তো জানি না।
মউডুবিতে খুব নারকোল হয়।
তা হয়। তবে লোকে টাটকা নারকোল পেলে কি আর নারকোলের গুঁড়ো নিবে?
আমি টপ করে বললাম, আদাও তো বাজারে টাটকা পাওয়া যায় তবে আদার গুঁড়ো বিক্রি হয় কেন?
চতুর্ভুজ অবাক হয়ে বলে, হয় নাকি?
না হলে বললাম কেন? গুড়ো নারকোলের অনেকগুলো প্লাস পয়েন্ট আছে। আজকালকার বউ-ঝিরা ঘরের কাজ বেশি করতে চায় না। নারকেল কোরানোও এক মহা ঝামেলার ব্যাপার। ডিহাইড্রেটেড নারকোল পেলে তারা খুশিই হবে। তাছাড়া উত্তর ভারতের একটা মস্ত এলাকায় নারকোল হয় না। দক্ষিণ ভারত বা এদিক থেকে যা যায় তার দাম সাবাতিক। সুতরাং ডিহাইড্রেটেড নারকোলের বাজার আছে। অবশ্য যদি করা যায়।
চতুর্ভুজ এ কথাতেও বেশ উত্তেজিত হয় এবং বোধহয় স্বপ্ন দেখতে থাকে। যদিও ডিহাইড্রেটেড নারকোল ঘেঁ আমি আরও বড়লোক হলেও তার এক পয়সা লাভ নেই। সু সে আমার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে একটা গোলাপি ভাবীকালের কথা ভাবতে থাকে, তার চোখেমুখে একটা সশ্রদ্ধ স্বপ্নাচ্ছন্ন ভাব ফুটে ওঠে। সে বলে, মউডুবিতে এক সাহেবের একটা পোয় নারকোলবাগান আছে। ইজারা নেওয়ার চেষ্টা করব?
দাঁড়াও, আগে খোঁজ নিই নারকোলের ডিহাইড্রেশন সম্ভব কি না।
চতুর্ভুজ সে কথাকে পাত্তা না দিয়ে বলে, বঙ্কিম গাঙ্গুলিরও মেলা নারকেল গাছ। ফাঁকা জমিতে কেরালার কিছু জলদি জাতের আরও চারা লাগিয়ে দিলে পাঁচ বছরের মধ্যে ফলন পেয়ে যানে।
আমি তাকে আর থামানোর চেষ্টা করি না। গরিবের তো স্বপ্নই সম্বল, হোক না তা অন্যকে নিয়ে। চতুর্ভুজ নারকেল গাছের বাই-প্রোডাক্টগুলোর কথাও আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। দড়ি, পাপোশ, হুঁকোর থেলো, পুতুল, অ্যাশট্রে, ছাইদানি, আরও কত কী!
আজ একটু দেরি করে অসীমা এল। দেরি হওয়ারই কথা। শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীদের খুব জরুরি একটা মিটিং হয়ে গেল স্কুলে আজ। প্রসঙ্গ ছিল, করাপশন। স্কুলের বেশ কিছু টাকা নয়ছয় হয়েছে, হিসেব পাওয়া যাচ্ছে না, অডিটার অসন্তুষ্ট। এ সবই আমি আগে থেকে জানতাম।
আজ সন্ধে হয়ে গেছে এবং বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। কাজেই আজ আমাদের বনে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অসীমা তার বেঁটে ছাতাটা দরজার পাশে রেখে আধভেজা শরীরে ঘরে ঢুকতেই চতুর্ভুজ সবেগে বেরিয়ে গেল। প্রেমিক-প্রেমিকাকে ডিস্টার্ব করতে নেই।
অসীমার মুখ চোখের চেহারা আজ আরও খারাপ। ওর ভিতরকার সব আলোই যেন নিভে গেছে। উপমাটা কারও কারও অপছন্দ হতে পারে। কিন্তু আমি মানুষকে মাঝে মাঝে বাড়ি হিসেবেও দেখি। এক-একটা মানুষকে দেখে মনে হয়, সব ঘরে আলো জ্বলছে, জানলা দরজা খোলা, পর্দা উড়ছে হাওয়ায়, এইসব মানুষেরা হা হা করে হাসে, উচ্চৈঃস্বরে কথা বলে, এদের জীবনে দুঃখ বড় ক্ষণস্থায়ী। কিছু কিছু মানুষের দু-একটা ঘরে আলো জ্বলে, বেশিরভাগ জানালা কবার্টটাই থাকে বন্ধ। আর কিছু মানুষ জন্মদুঃখী। ওদের বড়জোর বাথরুমে একটুখানি আলো জ্বলে। জানান দেয় যে, লোকটা আছে। অসীমার আলোর জোর নেই, জানালা কপাট সবই প্রায় বন্ধ। তবু এক চিলতে কপাটের ফাঁক দিয়ে একটু যে আলো দেখা যেত তাও যেন কে আজ এক ফুকারে নিভিয়ে দিয়েছে।
সে বসলে আমি জিজ্ঞেস করি, আজ মিটিং-এ কী হল?
অসীমা মাথা নেড়ে বলল, কিছু হয়নিখুব গণ্ডগোল হয়ে মিটিং ভেঙে গেল।
সেরকমই কথা। তবু আমি মুখখানা নির্বিকার রেখে বললাম, কী নিয়ে গণ্ডগোল?
কমলাদি তোমার এগেনস্টে চার্জ আনার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কয়েকজন কমলাদির এগেনস্টে কথা বলতে শুরু করে দিল। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক।
অস্বাভাবিক কেন?
টিচাররা এতকাল কেউ কমলাদির বিরুদ্ধে একটিও কথা বলত না, দু-একজন ছাড়া। আজ অনেকেই দেখলাম কমলাদির বিরুদ্ধে। তবে তারা যা বলছিল তা আমাদের আজকের এজেন্ডায় ছিল না।