- বইয়ের নামঃ শিউলির গন্ধ
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. পারিজাত
১। পারিজাত
হে দরিদ্র ভারতবাসী, মূর্খ ভারতবাসী, অজ্ঞ ভারতবাসী, তোমরা আমার ভাই, আমার বন্ধু, আমার একান্ত আপনার জন্য। আমি তোমাদেরই লোক। আমি যখন দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করতাম তখন যেমন, এখন দারিদ্র্যসীমার কিছু ওপরে বাস করার সময়েও তেমনই আমি তোমাদেরই লোক হয়ে গেছি। দারিদ্র্যসীমা হল একটা রেললাইনের মতো। মাঝখানে উঁচু রেলবাঁধ, তার দুধারেই লোকালয়। ওধারে তোমরা, এধারে আমরা। তবু আমি সেই রেলবাঁধ পেরিয়ে মাঝে-মাঝেই গিয়ে দেখে আসি ওপারের ভারতবর্ষকে। দারিদ্র্যসীমার নীচেকার ওই ভারতবর্ষই তো আমার শৈশবের মাতৃক্রোড়, কৈশোরের চারণভূমি, যৌবনের উপবন। দারিদ্র্যসীমা বা রেলের ওই বাঁধটা এমন কিছু পাকাঁপোক্ত বাধাও নয়। এ ধারের লোক প্রায়ই ওধারে যায়, ও ধারের লোক আসে এধারে। কোনও পাসপোর্ট বা ভিসা লাগে না। দারিদ্র্যসীমার নীচেকার ওই ভারতবর্ষে এখনও আমার বিস্তর আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু রয়ে গেছে।
বন্ধুগণ, ভারতবর্ষ ঠিক কয় ভাগে বিভক্ত তা আমি জানি না। তবে গুণেনবাবু জানেন। তিনি এ বিষয়ে যে গবেষণাগ্রন্থটি রচনা করছেন তা শিগগিরই থিসিস হিসেবে পাঠাবেন বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি বলেন, ভারতবর্ষকে ধর্ম, অর্থনীতি ও ভাষার দিক দিয়ে অন্তত চোদ্দোটি ভাগ করা যায়। শুধু তা-ই নয়, বেসরকারি ভাবে সেই ভাগ হয়েও গেছে, শুধু সরকারিভাবে তা স্বীকার করা হয় না।
স্বীকার আমিও করি না। আমার রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতাটি মনে পড়ে। ওই যে কবিতাটি যার মধ্যে আছে এক দেহে হল লীন। আমার ছাই কিছুই ভাল মনে থাকে না। তবু আমি এক দেহে লীন হওয়ার তত্ত্বটা খুব বিশ্বাস করি। কিন্তু তা নিয়ে গুণেনবাবুর সঙ্গে তর্ক করতেও আমি যাই না।
তার সব কথা মেনে নিই বলে গুণেনবাবু যে খুশি হন তা মোটেই নয়। উনি সর্বদাই কিছু-না-কিছু নিয়ে তর্ক এবং তাতে জয়লাভ করতে ভালবাসেন। বলতে কী এইটেই ওঁর হবি। সারাদিন উনি প্রতিপক্ষ খোঁজেন এবং যে কোনও লোকের সঙ্গেই যে কোনও বিষয়ে একটা তর্ক বাধানোর চেষ্টা করেন। ওঁর ভিতরে তর্কের বিষদাত সর্বদাই শুলশুল করে। গুণেনবাবুর সঙ্গে আমার তর্ক না করার আর একটা কারণ হল, তার বোন অসীমার সঙ্গে আমার বিয়ের একটা কথা চলছে। অসীমা রোগা, কালো এবং অসুন্দরী হলে কী হয়, সে একটা ভাল জাতের কো-এডুকেশন স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমিসট্রেস, ডবল এম এ এবং বি এড-এ ফার্স্ট ক্লাস।
.
অসীমা একদিন আমার ঘরে একখানা বই ফেলে যায়। ইস্কুলের পাঠ্য বাংলা বই। তাতে আমি রবীন্দ্রনাথের সেই এক দেহে হল লীন কবিতাটি পেয়ে যাই। সেইদিনই গুণেনবাবুকে কবিতাটি শুনিয়ে বে-খেয়ালে বলে ফেলেছিলাম আপনি ভারতবর্ষকে যে চোদ্দোটা ভাগে বিভক্ত করেছেন আসলে ইমাজিনেশন।
তর্কের গন্ধ এবং প্রতিপক্ষ পেয়ে গুণেনবাবুর মুখ উজ্জ্বল হল, তিনি খুব ঠান্ডা গলায় শুরু করলেন, ইমাজিনেশন? ইমাজিনেশন? আপনি কি জানেন বিষুবরেখাও ইমাজিনেশন। হায়ার ম্যাথম্যাটিকসও ইমাজিনেশন! আপেক্ষিক তত্ত্বও ইমাজিনেশন! যারা এইসব ইমাজিন করেছে তারা কি ঘাস খায়?
বন্ধুগণ, এই ঘাস খাওয়ার কথায় আমি ভিতরে ভিতরে লজ্জা ও হীনমন্যতায় অধোবদন হয়ে যাই। কারণ আমাকে একবার বাস্তবিকই ঘাস খেতে হয়েছিল। তখন আমি দারিদ্র্যসীমার নীচে, অনেক নীচে বাস করতাম। আমার বাবা ছিলেন পোস্ট অফিসের সামান্য স্ট্যাম্প ভেন্ডর। তার ওপর দুরন্ত এক হাঁপানি রোগে এমন কাহিল যে বছরের ছমাস বিছানা থেকে উঠতে পারতেন না। সেবার ভারী বর্ষায় আমাদের এলাকাটা বানে ভাসছে। জলে ভিজে আমরা স্যাঁতা ও সাদা হয়ে গেছি। টানা তিন দিন আমাদের ভদ্রগোছের কোনও খাওয়া জোটেনি। একদিন মা আমাদের গমের সঙ্গে মিহি করে কুচোনো ঘাস ও অন্যান্য লতাপাতা লবণ দিয়ে সেদ্ধ করে দেয়। খুব আনন্দের সঙ্গে না হলেও আমরা ভাইবোনেরা তা বেশ পেট ভরেই খেয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু ঘাস খাওয়ার ফলে আমার মগজ তৃণভোজীদের মতো হয়ে গেছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।
ঘাস খাওয়ার সেই স্মৃতি আমাকে এতটাই অন্যমনস্ক ও বিষণ্ণ করে তুলল যে, গুণেনবাবুর যাবতীয় যুক্তিতর্কে আমি কেবল হুঁ দিয়ে গেলাম। উনি ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠে গেলেন।
আমার প্রতিবেশী জহরবাবু প্রায়ই বলেন, আপনার অতীতের সেইসব সাফারিংস নিয়ে একটা বই লিখুন না। এসব লোকের জানা দরকার। ইস্কুলেও পাঠ্য হতে পারে।
আমি বিনীতভাবে চুপ করে থাকি। জীবনী লেখার মতো বয়স বা সফলতা আমি এখনও অর্জন করিনি। তবু জহরবাবু কেন আমাকে জীবনী লেখার কথা বলেন তা আমি খানিকটা আন্দাজ করতে পারি। উনি জানেন, নিজের অতীত জীবনের দারিদ্র্য সম্পর্কে আমার একটা রোমান্টিক ভাবাবেগ আছে। আমি কত কষ্ট করেছি সেটা লোককে আমি জানাতে ভালবাসি। দ্বিতীয় আর একটা কারণ হল, আমি ইচ্ছে করলে ওঁর মেজো মেয়ের একটা চাকরি অসীমাদের স্কুলে করে দিতে পারি। কারণ আমি ওই স্কুলের সেক্রেটারি।
জহরবাবু তাই আমার কাছে যাতায়াত বজায় রাখেন। কিন্তু মুশকিল হল জহরবাবু যথেষ্ট কথা জানেন না, বেশিক্ষণ বাক্যালাপ চালানো তাঁর পক্ষে কষ্টকর এবং তেল দেওয়ার সঠিক পদ্ধতিও তিনি শেখেননি। তবু আমাকে ভিজিয়ে রাখার জন্য তিনি আমার কাছেই আমাকে একজন মহৎ মানুষ বলে প্রতিপন্ন করা চেষ্টা করে যান। তাঁর মতে দরিদ্র অবস্থা থেকে আমার এই উন্নতি যুদ্ধজয়ের মতো। আজকালকার যুগে এরকমটা নাকি দেখা যায় না।