কুঞ্জ ডিসপেনসারির দরজা খোলে। বাতি জ্বালে। বাসন্তীকে বলে–ভিতরে এনে শুইয়ে দে বেঞ্চিতে।
গোরুর গাড়ির গারোয়ান আর বাসন্তী ধরে ধরে আনে পটলকে। কুঞ্জ আর তাকায় না পটলের দিকে। তাকাতে নেই। মানুষের মন তো! হিংসে আসে, বিদ্বেষ আসে, সংকীর্ণতা আসে। বেদ হয়ে পড়ে, গণ্ডি হয়ে পড়ে। কোনওদিন কাউকে শত্রু ভাবে না কুঞ্জ। আজই বা ভাবতে গিয়ে নিজেকে ছোট করবে লে? সে যদি মরে তো মাথা উঁচু করে মরবে একদিন।
আলমারি খুলে হরেক ওষুধের নাম শুনন করতে থাকে সে। প্রতিটি লক্ষণ মিলিয়ে আস্তে আস্তে তার বাবা এইভাবে গুন গুন করনে। ধীরে ধীরে ওষুধের সংখ্যা কমে আসত। তারপর ঠিক একটা অমোঘ শিশির গায়ে হাত পড়ত তাঁর।
চোখে ভাল দেখতে পাচ্ছিল না কুঞ্জ। কিন্তু তাতে কোনও অসুবিধে নেই। কোন তাকে কোন শিশির পর কোন শিশি আছে তা তার মুখস্ত। একটু দোনোমোনো করতে করতে একটা শিশির গায়ে হাত রাখে সে।
পটল ওষুধটা খাওয়ার আগে মাথায় ঠেকাল।
ঘণ্টাখানেকের ওপর বসে রইল পটল। তারপর আর একটা ডোজ দিল কুঞ্জ। শিশিটা বাসন্তীর হাতে দিয়ে বলে নিয়ে যা। মাঝরাতে একবার খাওয়াস।
যাওয়ার সময় পটল কারও ওপর ভর দিল না। নিজে হেঁটে গেল। দরজার কাছ থেকে ফিরে চাইল একবার। অস্পষ্ট স্বরে বলল–হরিবাবা আজ নিজে এসেছিলেন। স্পষ্ট টের পেলুম।
.
চেয়ারে নেতিয়ে ঝুম হয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকে কুঞ্জ। বড় শীত। খোলা দরজা দিয়ে হুড় হুড় করে ঠাণ্ডার ধারালো হাওয়া আসে। কুঞ্জ চোখ বুজেও টের পায়, সামনেই সেই গড়ানে উপত্যকা, কী সবুজ! কী গভীর!
বহুকাল বাদে বাবা যেন ডিসপেনসারিতে এলেন আবার। কুঞ্জর পিছনে অস্ফুট গুন গুন স্বরে ওষুধের নাম বলতে বলতে আলমারি হাতড়াচ্ছেন। বাবা? নাকি রাজু? একবার মুখ ফিরিয়ে কুঞ্জকে দেখলেন, খুব হেলাফেলার গলায় জিজ্ঞেস করলেন-তুই মরতে চাস কেন কুঞ্জ?
-না মরে কী হবে?
–জীবনটা কি তোর?
তবে কার?
যদি জানতিস কত করে একটা মানুষ জন্মায়, কত কষ্ট, কত খেসারত, কত রহস্য থেকে যায় পিছনে! তুই কি তোর জীবনের মালিক? মানুষের একটা স্রোত, একটা ধারায় তুই একজন। কত কষ্ট হয় গাছের একটা ফল ধরাতে জানিস?
–সব জানি, সব জানি। আর কিছু জানার নেই।
তুই যে বড় ভালবাসতে জানতিস কুঞ্জ!
কুঞ্জ ধীরে ধীরে মুখ ফেরাতে চেষ্টা করে। ডানদিকে ফেরাতে পারে না, শক্ত ঘাড়। তাই অল্প শরীর ঘুরিয়ে তাকায়। ঘোলা চোখে কিছুই স্পষ্ট দেখতে পায় না সে। এখনও চারদিকে অবাস্তব, অপ্রাকৃত, ভূতুড়ে জগৎ। কী প্রকাণ্ড জ দেখায় ওষুধের আলমারিগুলোকে। আলোটাকে মনে হয় গাঢ় হলুদগোলা জলের মতো অস্বচ্ছ। খুব অস্পষ্ট এক ছায়ার মতো মানুষকে দেখতে পায় সে। ছায়াও নয়, যেন কেউ ঘরের শূন্যতায় নিজের একটা ছাপ ফেলে রেখে চলে গেছে। ও কি বাবা? নাকি রাজু?
কুঞ্জ বলে–তুই কি রাজু। রাজু, ভোর রাতে ঘুমের মধ্যে কত ভয়ের শব্দ, যন্ত্রণার শব্দ করেছিস! কত কথা বলেছিস! তোর কীসের দুব তা তো জানি না রাজু, তবে মনে হয়, কলকাতা শহর তোকে অল্প অল্প করে বিস্কুটের মতো ভেঙে ভেঙে খেয়ে নিচ্ছে। টের পাস না? তোকে যেমন খাচ্ছে শহর, আমাকেও তেমনি
ছায়ামূর্তি গাঢ় শ্বাস ফেলে বলে সব শহরই মানুষ খায়। সাপের মতো বাঁকানো দাঁত, একবার ধরলে আর ছাড়তে পারে না। যদি জোর করে ছিনিয়ে আনিস তবে সাপের মুখের ব্যাঙ যেমন বাঁচে না শহর থেকে ছিনিয়ে আনা মানুষও তেমনি বাঁচে না। কলকাতা একদিন আমাকে খাবে। কিন্তু তুই যে বড় ভালবাসতে জানতিস কুঞ্জ!
–আমাকেও ভালবাসাই খেয়ে নিচ্ছে। তুমি কি বাবা? নাকি তুই রাজু? শোনো বাবা, আমি যে কুঞ্জনাথ! কুঞ্জনাথের কি কলঙ্ক মানায়!
রাজু নয়, যেন বাবা অলক্ষ্যে জবাব দেয় কিন্তু তুই যে একশো বছরের কথা বলেছিলি। মনে নেই? একশো বছর পরের কথা ভেবে দ্যাখ, কেউ মনে রাখেনি এসব। কে কুঞ্জনাথ আর কীই বা তার কলঙ্ক।
কে লোকটা তা বুঝতে পারে না কুঞ্জ। হয়তো বাবা, হয়তো রাজু। তার কাছে এখন জীবিত বা মৃত দুই জগৎই সমান। বাবা না রাজু তা বুঝতে পারল না কুঞ্জ। অস্পষ্ট লোকটার দিকে চেয়ে বলল বড় কষ্ট যে।
–তুই যে বড় ভালবাসতে জানতিস কুঞ্জ। কত ভালবাসা তোর চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
কুঞ্জ মাথা নেড়ে বলে–আমি বাঁচবনা, বড় জ্বর, বুকে ব্যথা, ডান ফুসফুসে জল জমছে হু হু করে।
বাবা বলে–দুর বোকা, ওঠ না। ডান দিকের আলমারির দুনম্বর তাকে খুঁজে দ্যাখ।
গড়ানে ঢালের মুখে কুঞ্জ থামে। নিজেকে ঠেলে দেওয়ার আগে একবার দেখে নেয় চারদিক। গহীন খাদ। সবুজ উপত্যকা কোল পেতে আছে। টলতে টলতে সে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ায়।
কুঞ্জ ডানদিকের আলমারির পাল্লা খুলে হাত বাড়ায়। ওষুধের নাম গুন গুন করতে থাকে আপনমনে।