দ্বিধা জড়ানো পায়ে বারান্দায় বেরিয়ে আসে বনশ্রী। বলে হল?
রাজু মুখ তোলে। একটু হাসে। মাথা নাড়ে।–না।
কী অদ্ভুত মানুষ। ওই সাইকেলটা না হলেই চলছিল না? বাড়িতে দুদুটো সাইকেল ছিল যে?
রাজু মৃদু হেসে বলে–এই সাইকেলটার কাছ থেকে আমার অনেক কিছু জেনে নেওয়ার আছে।
বনশ্রী হেসে ফেলে। বলে মাথায় পোকা।
রাজু গম্ভীর মুখে চায়। ফের মুখ নিচু করে ঝামা দিয়ে রবার ঘষে পাতলা করতে করতে বলে এই সাইকেলটারও কিছু বলবার আছে। শুনতে জানা চাই। সব জিনিসের মধ্যেই ঘটনা প্রবাহ, চেতনা আর চিন্তার কিছু ছাপ থেকে যায়। নইলে গ্রামোফোনের নিষ্প্রাণ রেকর্ড কি গান ধরে রাখতে পারত?
বনশ্রী তর্ক করল না। কেনই বা করবে? সে এ রকম কথা জয়ে শোনেনি। এ সব কথার প্রতিবাদ করারও কিছু নেই তো! শুনতে বেশ লাগে। হতেও তো পারে!
বলল-আমাকে শেখাবেন?
রাজু রবারে সলিউশন লাগিয়ে টিউবের ফুটোয় চেপে ধরে বলে কী?
কী ভাবে সাইকেলের কথা বোঝা যায়।
রাজু ঘাড় কাত করে বলে–শেখাব।
টিউবের ফুটো বন্ধ হয়ে গেল অবশেষে। রাজু সাইকেল দাঁড় করিয়ে হাওয়া ভরে। ক্রমে টনটনে হয়ে ওঠে চাকা। বড় উঠোনটায় সাইকেলটাকে একটা চক্কর দিয়ে এনে বারান্দায় পা ঠেকিয়ে দাঁড় করায় রাজু। বলে–চমৎকার।
জড়ো করা হাঁটুতে খুঁতনি রেখে চেয়ে স্মিত হাসে বনশ্রী। বলে সাইকেল কী বলল?
রাজু হাসে একটু-সাইকেল বলল, রাজু, আজ সকালেও আমি রেবন্তর ছিলুম, এখন তোমার।
বনশ্রী চোখ বড় করে বলে আপনার মানে? জামাইবাবুকে সাইকেল ফেরত দেবেন না নাকি আপনি?
রাজু মৃদুস্বরে বলে কথাটা তো আমার নয়। সাইকেলের। সাইকেল হয়তো ভুল বলছে, কিন্তু বলছে।
–আর কী বলছে?
রাজু দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব কিছু কি সহজে বোঝা যায়? আরও অনেক কিছু বলার আছে এর। ধীরে ধীরে বলবে।
রাজু আবার ধীর গতিতে সাইকেল ছাড়ে। উঠোনে চক্কর দিতে থাকে আস্তে আস্তে।
বনশ্রী জিজ্ঞেস করে-কী বলছে?
রাজু ভ্রূ কুঁচকে বলে–ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি জানতে চাই ভরদুপুরে এই সাইকেলটা কেন আপনাদের বাড়ির চারদিকে চক্কর মারছিল।
নত্রীর মুখে ধীরে একটা ছায়া নামে। সে মৃদুস্বরে বলে–আমি জানি না।
রাজু মৃদু হাসে আপনার কাছে জানতে চায়নি কেউ। সাইকেলই বলবে।
বনশ্রী হঠাৎ তার বিশাল চোখে চেয়ে বলে–ওটা অলক্ষুণে সাইকেল। আপনি ওতে আর চড়বেন না। নামুন শিগগির নেমে আসুন!
আত্মবিস্মৃত বনশ্রী বারান্দার প্রান্তে এগিয়ে আসে। সাইকেলের হ্যান্ডেলে হাত রেখে ঝুঁকে বলে– আর কিছুতেই না। সাইকেলের কথা বুঝবার দরকার নেই আমাদের।
রাজু চেয়ে দেখে, সকালে যে লোকটা আয়নার আলো ফেলার মতো করে নিজেকে দূর থেকে বনশ্রীর মুখে প্রক্ষেপ করছিল বার বার সে লোকটার দম ফুরিয়েছে। রূপমুগ্ধ সেই অন্যমনস্কতা কেটে গেছে বনশ্রীর।
রাজু সাইকেল থেকে নামে। একটু ভেবে বলে–আমারও তাই মনে হয়। সাইকেলের কাছ থেকে আর কিছু না জানলেও আমাদের চলে যাবে।
বেলা ঢলে পড়ছে। গাছগাছালির রূপময় ছায়া উঠোনে নকশা ফেলে এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। দূরে কুয়োয় বালতি ফেলার শব্দ হল ছপ। একটা কোকিল শিউরে উঠল নিজের ডাকে।
.
সাবিত্রী পাশ ফিরল। বড্ড যন্ত্রণা। আবার ও-পাশ ফিরল। বড় যন্ত্রণা!
ডাকল–টুসি! ও টুসি!
কেউ সাড়া দিল না।
বড় অভিমান হল, বড় একা লাগল সাবিত্রীর। শিয়রের জানালায় রোদ মরে এল। মহানিমের গাছে কুলকুল করে পাখি ডাকছে হাজারে-বিজারে।
সাবিত্রী শিয়রের জানালার দিকে তাকায়। ও পাশে কেউ নেই, জানে। তবু খুব কষ্টে উঠে বসে সাবিত্রী। জানালার দিকে চেয়ে বলে–আপনার জন্য বড় কষ্ট হচ্ছে। কোথায় আপনি?
বলে কান পেতে থাকে সাবিত্রী। পায়ের দিকের জানালা দিয়ে হু হু করে উত্তরে বাতাস এসে দক্ষিণের জানালা দিয়ে বয়ে যায়।
সাবিত্রী বলে–এরা কেবল ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখছে আমাকে। আবার হয়তো এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়ব। কোথায় আপনি?
কেউ নেই।
সাবিত্রীর চোখ ভরে জল আসে। বড় অভিমান। বলে নিজেকে কক্ষনও খারাপ ভাববেন না। লোকে বলবে লম্পট, চরিত্রহীন! লোকে কত বলে। ওরা তো জানে না! দোহাই, আপনার পায়ে পড়ি, আপনি নিজে কখনও নিজেকে ভাববেন না।
উত্তর থেকে বাতাস দক্ষিণে বয়ে যায়। বড় ঠাণ্ডা হিম বাতাস। একটা জোলো অন্ধকার ঘনিয়ে ওঠে। আকাশে একটা-দুটো তারা ফোটে।
সাবিত্রী ঘুমিয়ে পড়ার আগে চোখের জল মোছে। শিয়রের জানালার দিকে চেয়ে বলে–মরে গিয়ে আমাদের কারও লাভ নেই। আছে, বলুন? রবার ঘষে ঘষে পেনসিলের দাগ তুলতুম ইস্কুলে। দাগগুলো না হয় বাদবাকি জীবন ধরে তুলে ফেলব দুজনায়। বলছি তিন সত্যি, আর রক্ত-মাংসের মানুষের মধ্যে নামিয়ে দেখব না আপনাকে দূরে থাকবেন, কিন্তু বলুন বেঁচে থাকবেন।
সাবিত্রী উৎকর্ণ হয়ে চেয়ে থাকে জানালার দিকে। কেউ জবাব দেয় না। শুধু পাখিদের শব্দ গাঢ় হয়। বাতাস নদীর স্রোতের মতো শব্দ তুলে গাছগাছালির ভিতর দিয়ে বয়ে যায়।
অবসন্ন মাথাটা বালিশে ফেলে সাবিত্রী। আবার একটা ঘুমের ঢল নেমে আসছে।
সাবিত্রী চোখ বোজে। নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে পড়ে। চোখের কোলে জল শুকিয়ে কনো নদীর খাতের চিহ্ন আঁকা হয়।
.
কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও বুকে হেঁটে ধীরে ধীরে প্রকাণ্ড মাঠখানা পার হয় কুঞ্জ। কাঁচা হলুদ রঙের রোদ রক্তের মতো লাল হয়েছিল, তারপর গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেছে চরাচর। আকাশে হাজারো লণ্ঠন জ্বলে ওঠে। কুঞ্জ দেখে, এক মস্ত সমুদ্রের ধারে বিশাল জাহাজঘাটায় আলো জ্বলছে। সে ওইখানে যাবে।