খুশি হয়ে কুঞ্জ খুব আবেগের গলায় বলে–সে বড় ঠিক কথা। কিন্তু মেয়েরা এ সব বুঝতে চায় না কেন রে? বড় বোকা মেয়েমানুষ জাতটা।
মনে মনে রাজু বলে–কিংবা খুব চালাক।
পুকুরধার, বাগান, নারকোলকুঞ্জের ভিতর দিয়ে পথটা পাক খেতে খেতে গেছে। তারপরই মাঠ। রবি মাঠের ধারে পৌঁছে পিছনে টর্চ মেরে বলে–এসে গেল গো! ভেজা মাটির গন্ধ পাচ্ছি।
গাছের আড়াল সরে যেতেই হাওয়ার ঢল এসে লাগল বুকে। কী শীত! বাতাসে জলের হিম। এত হাওয়ায় স্বাসকষ্ট হতে থাকে রাজুর। কান কনকন করতে থাকে, নাকের ডগায় জ্বালা। তবু এই মাঠখানা রাজুর বরাবর ভাল লাগে। তেপান্তরের মতো পড়ে আছে উজবুক একটা মাঠ। এখানে সেখানে চাষ হয় বটে, কিন্তু বেশির ভাগটাই এখনও সবুজ। একটা দুটো নৈর্ব্যক্তিক পুকুর আছে, মাঝে মাঝে গাড়লের মতো গজিয়েছে তাল বা নারকোল গাছ। মেঠো পথের ধারে ধারে ঝোপঝাড়ও আছে রহস্যের গন্ধ মেখে। জ্যোৎস্না ফুটলে এ মাঠে বিস্তর পরী নেমে আসবে বলে মনে হয়।
কয়েক কদম আগে আগে কুঞ্জ ভারী আনমনা হয়ে হাঁটছে। ওর মাথা ভর্তি এখন তনুর স্মৃতি। কত জ্যান্ত আর শরীরী হয়ে তনু ওর মনে হানা দেয় এখনও! ভেবে রাজুর কষ্ট হয়। কুঞ্জর সঙ্গে তনুর অসম্ভব বিয়েটা যদি ঘটনাচক্রে ঘটতই তা হলে কি রাজু খুশি হত? না, কিছুতেই না! তনু ঠিক লোককেই বিয়ে করেছে, এমনকী জাত বর্ণ পর্যন্ত মিলিয়ে। এখন এই বিরহে কাতর কুঞ্জটার জন্য তবে কেন কষ্ট রাজুর? মুখ ফুটে কোনওদিন তনুকে ভালবাসার কথা রাজুকে বলেনি কুঞ্জ, শুধু বরাবর আভাস দিয়েছে।
রবি এদিক ওদিক টর্চ ফেলছে। উল্টোপাল্টা হাওয়ায় মাঝে মাঝে তার গানের শব্দ আসছে। এই বিশাল মাঠে, ঢলানি হাওয়ায়, অন্ধকারে তারা তিনজন যেন বহু দূর-দূর হয়ে গেছে। যেন কেউ কারও নয়। যেই এই একা হওয়ার বোধ এল অমনি রাজুর বুক খামচে ধরল সেই ভয়। সকলের অজান্তে কে এক মৃত্যুর জাল ছুঁড়ে দিচ্ছে অকে ধরার জন্য!
রাজুর হাঁফ ধরে যায়। গলার কাছে কী যেন পুঁটুলি পাকিয়ে উঠে ঠেলা দেয়। শরীরের কিছুই তার বশে থাকে না।
গভীর কালো একটা পাথুরে আকাশে নীলাভ উজ্জ্বল এক রথ কোনাকুনি ধীর গতিতে উঠে যাচ্ছে– এই স্বপ্ন এক রাতে দেখেছিল সে। আর কিছু নয়, শুধু এক তারা চাঁদ সূর্যহীন নিকষ আকাশ, আর ওই ভুতুড়ে রথ। ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়েছিল তার। শব্দহীন তলহীন ওই কালো আকাশ কখনও দেখেনি সে জীবনে। আর সেই নীল আলোয় মাখা রথই বা এল কোথা থেকে? যতবার সে রাতে ঘুমোত গেল ততবার দেখল। হুবহু এক স্বপ্ন। কেউ কি দেখে এরকম। শেষ রাতটুকু জেগেই কাটাল। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত মাস তিনেক ধরে প্রতি রাত প্রায় জেগেই কাটে তার।
রথযাত্রায় ছাড়া সারা জীবনে রাজু আর রথ দেখল কই? তা ছাড়া ওরকম নীলাভ সুন্দর রথের ছবিটাই বা সে পেল কোথায়? আকাশটাই বা কালো কেন? কেন ধীরগতিতে রথ উপরে উঠে যাচ্ছে? অনেক যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে এই স্বপ্নের সামাজিক বাস্তব ব্যাখ্যা খুঁজে দেখেছে রাজু। কিছু পায়নি। কিন্তু উড়িয়েও দিতে পারেনি কিছুতেই। কেবলই মনে হয়, এই যৌবনের চৌকাঠেই বুঝি মৃত্যুদূত পরোয়ানা নিয়ে এল! কাউকেই স্বপ্নের কথা বলেনি সে। কিন্তু মনে মনে ভেবে দেখেছে, এ স্বপ্ন মৃত্যুর ইঙ্গিত ছাড়া কিছুই নয়। গত তিন মাসে তার শরীর গেছে অর্ধেক হয়ে। খায় না ভাল করে, ঘুম নেই। সারাদিন একটা দূরের অস্পষ্ট সংকেত টের পায়। রাতে সেটা গাঢ় হয় আরও। মৃত্যু আসছে। আসছে।
এই মাঠের মধ্যে ঠিক তেমনি মনে হল। বড় দামাল হাওয়া, বড় খোলামেলা মাঠ, অনেক দূর হয়ে গেছে লোকজন।
কাতরস্বরে রাজু ডাকে– কুঞ্জ।
কিন্তু কুঞ্জ শোনে না। রাজুর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে মুছে ফেলে দেয় বাতাস।
সামনে, কিছু দূরে তখন হঠাৎ রবির হাতের টর্চটা ছিটকে পড়েছে মাঠে। পড়ে লাশের মতো স্থির হয়ে একদিকে আলোর চোখ মেলে চেয়ে আছে। সেই আলোয় বিশাল প্রেতের ছায়া নড়ছে। কয়েকটা পা, লাঠি।
রবি কি একবার চেঁচাল? বোঝা গেল না, তবে সে টর্চটা কুড়িয়ে নেয়নি তা বোঝা যাচ্ছিল।
কুঞ্জ হেঁকে বলল-রাজু! ডাইনে নেমে যা।
কাঁপা গলায় রাজু বলে-কেন?
সে কথা কানে গেল না কুঞ্জর। দু হাত ওপরে তুলে পাগলের মতো সামনের দিকে ছুটতে ছুটতে সে চেঁচাতে লাগল-খুন! খুন! খুন!
রাজু খুনের মতো কিছু তেমন দেখতে পায়নি। কুঞ্জর মতো তার চোখ অত আঁধার-সওয়া নয়। বিজলি বাতি ছাড়া শহুরে রাজু ভারী অসহায়। কিন্তু কুঞ্জ যখন দেখেছে তখন ঠিকই দেখেছে।
রাজুর বুকে এমন ওলট পালট হচ্ছিল যে দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। সে ডানদিকে মাঠের মধ্যে ছুটতে গিয়ে দেখে, পা চলে না। শরীরে খিল ধরে আসছে।
কুঞ্জ চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটছে সামনে। কিন্তু এই বিশাল মাঠে হাওয়ার ঢল ঠেলে সেই চিৎকার কোথাও যাচ্ছে না। দুরে ভঞ্জদের পাড়ায় নিওন বাতি জ্বলছে, রাস্তায় আলোর সারি। লোকজন রয়েছে। কিন্তু অত দূর পর্যন্ত কোনও সংবাদই পৌঁছচ্ছে না।
মাঠের মধ্যে বুন্ধুর মতো দাঁড়িয়ে রাজু সিদ্ধান্ত নিল, কুঞ্জটা মরতে যাচ্ছে, মরবেই।
এটা ভাবতেই তার মাথা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। কুঞ্জকে কি মরতে দেওয়া যায়? যার বুকে অত ভালবাসা? যে কখনও কাউকে অবহেলা বা অবজ্ঞা করে না? কুঞ্জর মতো ভাল কজন?