ভাবতে ভাবতে দর্জিঘরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে একটু চোখ বুজেছিল কুঞ্জ। অমনি যেন কোত্থেকে কেষ্ট এসে সামনে দাঁড়াল। লাল চোখ, উলেগুলো চুল, বিকট মুখ। বলল- তা বটে। তুমি হলে এ তল্লাটের মস্ত মাতব্বর কুঞ্জনাখ। তবে কী জানো বড় মানুষের দিকেই সকলের চোখ একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। নজর রাখে, লোকটা দড়ির ওপর কি মতো হাঁটতে পারছে কিনা। নাকি টাল খাচ্ছে পড়ো-পড়ো হচ্ছে, কিংবা পড়েই গেল নাকি। উঁচুতে উঠলে তাই সবসময়ে পড়ার ভয়। আমাদের মতো মদো মাতাল বদমাশ যত যাই করি লোকে তেমন মাথা ঘামায় না। কিন্তু তুমি হলে কুঞ্জনাথ, তুমি পড়লে লোকে ছাড়বে কেন? বড় মানুষ পড়লে লোকের ভারী আনন্দ হয়। বড় মানুষের গায়ে থুথু দেওয়ার আনন্দ, বড় মানুষের গায়ে লাথি দেওয়ার আনন্দ।
একটা বিলি ব্যবস্থা হয়েছে দেখে নিশ্চিন্তু মনে মাতব্বররা যে যার রওনা দিচ্ছে। নেত্য সাঁপুই এসে কুঞ্জর কাঁধে একটা ঠেলা দিয়ে বলল-পোয়াতি বউটা তোমার জন্যই প্রাণে বেঁচে গেল এ যাত্রা। গোপাল ডাক্তারও বলছিল,কু না থাকলে কেষ্টর বউয়ের হয়ে গিয়েছিল।
মড়ার চোখে কুঞ্জ তাকায়। শুকনো ঠাটে একটু হাসবার চেষ্টা করতে গিয়ে রক্তের নোনতা স্বাদ কে জিভে। সবাই জানে, নেত্য সাইয়ের পোষা ভূত আছে। এ তল্লাটের লোকের যত গুহ্য আর গুপ্ত কথা, যত কেলেঙ্কারি আছে তার সব খবর এনে দেয় নেত্যকে। নেত্য বাতাস শুঁকে টের পান কোথায় মানুষের পচন ধরেছে, নিশুত রাতে কার ঘরে কে যায়, কোথায় ইধার কা মাল উধার হয়।
কুঞ্জ চোখ নামিয়ে নেয়।
নেত্য আফশোসের গলায় বলে বাড়ি যাও। কাল সারাটা রাত জেগে কাটিয়েছ। কুঞ্জ ওঠে। নেত্য সঙ্গ ধরে আসতে আসতে বলে-বউটা রক্ষে পেল সেইটেই এখন মস্ত সানা। তুমি বুক দিয়ে না পড়লে বাঁচত না। গলাটা খাটো করে নেত্য হঠাৎ জিজ্ঞেস করে-কাল সাঁঝবেলায় বড় মাঠে নাকি কারা হামলা করেছিল তোমার ওপর। বলনি তো?
কুঞ্জ উদাস স্বরে বলেও কিছু নয়। চোর-টোর হবে, আমাদের দেশে পালিয়ে যায়।
-কেষ্টর কোনও খোঁজ পেলে?
–খোঁজ করিনি।
নেত্য খুব রাগ দেখিয়ে বলে–খোঁজ নেওয়া উচিতও নয়। পাষণ্ড একেবারে। মুখেরও লাগাম নেই।
শীতটা হঠাৎ ভারী চেপে ধরে কুঞ্জকে। নেত্যর শেষ কথাটায় একটু ইঙ্গিত আছে না? মুখের লাগাম নেই কথাটার মানে কী?
নেত্য সাঁপুইয়ের মুখের দিকে আর তাকাল না কুঞ্জ, বাঁ ধারে ঢালুতে নেমে যেতে যেতে বলল চলি নেত্যদা, শরীরটা ভাল নেই।
নেত্য চেঁচিয়ে বলে–এসো গিয়ে।
খালপোলে উঠতে গিয়ে এতক্ষণ বাদে কুঞ্জ আবার তার শরীরটাকে টের পায়। গা ভরে জ্বর আসছে। বুকের ব্যথা চৌদুনে উঠে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। খাসকষ্ট চেপে ধরছে কঠা। দুপুরের সাদা রোদকে হলুদ দেখাচ্ছে চোখে। পুরো রাস্তাটা হেঁটে পার হওয়া যাবে না। কুঞ্জ সাঁকোর ধারে দুর্বল মাথা চেপে উবু হয়ে বসে পড়ে। সুযোগ পেয়ে কেষ্ট যেন সামনে এসে দাঁড়ায়, দাঁত কেলিয়ে হাসে, বলে মানুষ পচলে তার গন্ধ বেরোবে না? তোমাকে যে পচায় ধরেছে তা আপনি ছড়িয়ে পড়বে। ও কি ঠেকানো যায়? আমার মুখের কথা বলে লোকে হয়তো প্রথমটায় তেমন বিশ্বাস করবে না, ভাববে কুঞ্জনাথ কি কখনও এ রকম হতে পারে? কিন্তু ধীরে ধীরে পচা গন্ধ ছড়াবে ঠিকই।
সাবিত্রীকে বলে এসেছিল কুঞ্জ, মরবে। মৃত্যুর একটা গহীন গড়ানে ঢালু উপত্যকা এখন তার সুমুখেই। যদি এখন নিজেকে একটু ঠেলে দেয় কুঞ্জ, যদি কোনও কিছু আঁকড়ে না ধরে তবে গড়াতে গতাতে ঝম করে পড়ে যাবে নীচে, যেখানে মায়ের মতো কোন পেতে আছে শমন। নিজের রোগলক্ষণ চেনে সে। ডান বুকে জল জমছে। ব্যথা জ্বর। আজ ফিরে গিয়ে পুকুরে হিম ঠাণ্ডা জলে খুব ডুবে ডুবে স্নান করবেকুঞ্জ। ভাত খাবে। রাতে শিয়রের জানালা খোলা রেখে শোবে। নিজেকে একটু ঠেলে দেওয়া মাত্র।
মুখ তুলে সে তনুকে দেখতে পায় মনের মধ্যে। ভারী জলজ্যান্ত দেখতে পায়। বলে, অনু, একদিন তুমিও তো জানতে পারবে কুঞ্জদাকে যা ভাবতে তা সে নয়।
তনু করুণ মায়াভরা চোখে চেয়ে বলে, আমি তো তোমাকে কখনও ভুলিনি কুঞ্জদা। ঘর-সংসারের মধ্যে জড়িয়ে থাকি তবু এক মুহূর্ত আমার মন তোমাকে ছাড়া নয়। তবে তুমি কী করে ভুললে আমাকে? অন্য মেয়ে, পরের বউ তাকে কী করে চাইলে?
কুঞ্জ মাথা নেড়ে বলে, সাবিত্রীকে তো আমার মন চায়নি তনু, শরীর চেয়েছিল। আমার শরীর এঁটো হয়েছে, মন নয়। ঠিক তোমার যেমন।
খালধারে মজন্তালির বাড়ি। কুঞ্জকে দেখে বেরিয়ে এল কী গো, বসে পড়লে যে। শরীর ভাল তো?
কুঞ্জ মাথা নাড়ে–ভালই।
বলে উঠে দাঁড়ায়। মাথা টলমল করছে। দুপুরের রোদে কাঁচা হলুদের রং দেখছে সে। আর চারদিকটা কেমন যেন থিয়েটারের সিনসিনারির মতো অবাস্তব। কুঞ্জ হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, সে যেন কল্পনার রঙে ডোবানো অদ্ভুত এক স্বপ্নের মতো জায়গায় ঢুকে যাচ্ছে। চারদিকটা গভীরভাবে অবাস্তব, অপ্রাকৃত পরীর রাজ্য যেন। ঝিম ঝিম নেশার ঘোরের মতো জ্বর উঠছে তারা ফিরে যাবেনাকি? রিকশা ধরে নিতে পারবে বাজার থেকে কিংবা নিদেন কারও সাইকেলে সওয়ার হতে পারবে।
একটু দাঁড়ায় কুঞ্জ। তারপর ভাবে, নিজেকে সেই গহীন খাদটার দিকে একটু একটু করে ঠেলে দেওয়াই ভাল। সে ফেরে না। বড় মাঠের দিকে এগোতে থাকে।