কুঞ্জ অসাড় হয়ে বসে থাকে। পপুলারিটি কথাটা খামচে ধরে মাথা। এক নাগাড়ে অনেক কথা বলে ভারী ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সাবিত্রী। থর থর করে কাঁপছিল, ঠোঁট সাদা। লেপ টেনে মুড়ি দিয়ে গভীর ব্যথা-বেদনার শব্দ করে বলল–আমার শরীর বড্ড খারাপ লাগছে। ভীষণ শীত আর কাঁপুনি।
কুঞ্জ টুসিকে ডেকে তোলে। রাঙাকাকি আর মাকে ডেকে আনে।
.
০৬.
এতদিনে তবে কি বুড়ো হল পটল? চোখে ছানি আসছে নাকি? একটু আলো লাগলেই চোখ বড় ঝলসে যায় যে আজকাল? নইলে কি রবিকে কুঞ্জ বলে ভুল করত? টর্চের আলোটা এমন বিশাল গোলপানা চক্করের মতো ঝলসে উঠেছিল যে ধাঁধা লেগে গেল। সে ভুলটাও শুধরে নিতে পারত। কিন্তু একটা ফাঁকা আওয়াজে, একটা উটকো লোকের হাঁকাড় শুনে মাথাটা কেন যে ঘেবড়ে গেল আজ। হাবুর ঘরে মুড়িসুড়ি দিয়ে বসে অফুরন্ত হাঁফের টান ভোগ করতে করতে এইসব কথা ভাবে পটল। শ্লেষ্মর পর শ্লেষ্ম উঠে আসছে কাশির সঙ্গে। হরি ডাক্তার মরে গিয়ে অবধি এই শ্লেষ্মর আর চিকিৎসা হল না। বুকের মধ্যে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে শ্বাসের কষ্ট। এরপর কি মরবে পটল? ঝাড়গ্রামে মামাশ্বশুর সস্তায় একটা কলাবাগান বেচে দিচ্ছে। পটলের বড় ইচ্ছে, বাগানটা কেনে। মরবার আগে ছেলেপুলে সহ বউ বাসন্তীকে ঝাড়গ্রামে বসিয়ে যেতে পারলে একটা কাজের কাজ হয়। বাসন্তীর ব্যবসার মাথা আছে, কলা বেচে ঠিক সংসার চালিয়ে নেবে। আজ কুঞ্জকে খুন করতে পারলে রেবন্তবাবু বাগান কেনার টাকা দেবে, কথা ছিল। খুন পটলের কাছে নতুন জিনিস তো নয়। পলিটিক্সয়ালাদের হয়ে, জোত-মালিকের হয়ে, হরেক কারবারির হয়ে নানান রকম মানুষ মেরেছে সে। সেজন্য বড় একটা আফশোসও নেই তার। মশা মাছি, পাঁঠা ছাগল মারলে যদি পাপ না হয় তবে মানুষ মারলেও হয় না। আর যদি পাপ হয়ই হবে পাঁঠা-ছাগল মারলে যতটা হয় তার বেশি হয় না। এ তত্ত্ব পটল অনেক ভেবে ঠিক পেয়েছে। কিন্তু এখন তার সন্দেহ হয়, সত্যিকারের বুড়ো হল নাকি সে? ছানি আসছে চোখে? মাথাটা কাজের সময় ঠিক থাকছে না কেন? এমন হলে লাশটা ফেলতে পারবে না পটল, আর যদি না ফেলতে পারে তবে ঝাড়গ্রামের কলাবাগানটা যে হাতছাড়া হয়ে যাবে! রেবন্তবাবু দায়ে দফায় অনেক দেখেছে তাকে; তার এই কাজটুকু করে যে দিতেই হয় পটলকে! ভাবছে আর কাশছে পটল। হাবুর দেওয়া বড় মাটির ভাঁড়টা ভরে উঠল শ্লেষ্ময়। বড় শ্বাসের কষ্ট।
চ্যাটাইয়ের অন্যধারে বসে কালিদাস তাড়ি টানছিল খুব। মাথাটা টলমলে হয়ে এসেছে। মিটিমিটি হাসছে আর পটলের দিকে চাইছে। বিড়বিড় করে বলছে–হোমিওর কী গুণ বাবা! নিজের চোখে দেখলুম তো! কুঞ্জ ওই অত দূরে থাকতে পকেট থেকে শিশি বের করে ওষুধ খেল, আর সেই ওষুধের গুণে একশো হাত দূরে পটলার চোখে ধাঁধা লেগে গেল। শুধু তাই? হোমিওর গুণেই না কুঞ্জ আগেভাগে জানতে পেরেছিল যে আজ সে খুন হবে! তাইনা এক বকরাক্ষসকে জুটিয়ে এনেছিল সঙ্গে। কী চেঁচাল বাবা মুশকো লোকটা! কাঁচা খেয়ে ফেলত ধরতে পারলে। পটল যে পটল সেও ভয় খেয়ে পালায় না হলে? রেবন্তবাবুও ঘাবড়ে গেছে খুব। এই জল ঝড়ের মধ্যেই লেজ গুটিয়ে পালাল।
.
নারকোল বাগানের বাইরে আসতেই ধারালো বৃষ্টি ঘেঁকে ধরল রেবকে। পাথুরে ঠাণ্ডা জল। দমফাটা হুমো বাতাস খোলা মাঠের মধ্যে তাকে এলোমেলো ঘাড়ধাক্কা দিতে থাকে। দেয়ালের মতো নিরেট অন্ধকার চারদিকে, এক লহমায় ভিজে গেল রেবন্ত। গায়ের সোয়টার, জামা গেঞ্জি ছুঁড়ে জল ঢুকে যাচ্ছে ভিতরে। বৃষ্টি বাতাস আর মাঠে জমা জল ঠেলে জোরে হাঁটা যায় না। তবু প্রাণপণে হাঁটে রেবন্ত। শীতে ঠকঠক করে কাঁপে সে। দুটো কানে বিষফোঁড়ার যন্ত্রণা। ঝোড়ো বাতাস হাড়-পাঁজরায় ঢুকে প্রাণটুকু শুষে নিচ্ছে। তবু সে পিছন ফিরে একবার দেখে নিল, ছায়া দুটো পিছু নিয়েছে কিনা, ওই দুজনের কাছ থেকে এখন তাকে যতদূর সম্ভব তফাত হতে হবে।
শরীর অবশ করে গাঁটে গাঁটে যন্ত্রণা আর কাঁপুনি ধরে গেল। কানের যন্ত্রণাটা মাথাময় ভোমরার ডাক ডাকতে থাকে, চিন্তার শক্তি পর্যন্ত থাকে না। এই অবস্থায় কীভাবে সে শ্যামপুর পৌঁছল সেটা সে নিজেও ভাল বলতে পারবে না।
আবছা মনে পড়ে, বাজারে তেজেনের দোকান থেকে নিজের সাইকেলটা নেওয়ার সময় তেজেন বলেছিল, পাগল নাকি? এ ভাবে যেতে পারে মানুষ! থেকে যাও।
রেবন্ত কথাটা কানে নেয়নি, অন্ধকারে বৃষ্টি আর ঝড়ের মধ্যে সে প্রবল বেগে সাইকেল চালিয়েছিল। কয়েকবার সাইকেল হড়কে পড়ে গেল। চাকার রিমে টাল খেয়েছে। চালানোর সময় ফর্কের সঙ্গে টায়ার ঘষা খাচ্ছিল খ্যাস খ্যাস করে। জোরে চলতে চাইছিল না। তবু পৌঁছেও গেল রেবন্ত।
শ্যামশ্রীর সামনে কোনওদিন কোনও দুর্বলতা প্রকাশ করে না, আজও করল না। যখন উত্তরের দালানের বারান্দায় সাইকেলটা হিঁচড়ে তুলল তখন তার শরীর আপনা থেকেই টলে পড়ে যাচ্ছিল মেঝেয়। স্রেফ মনের জোরে খাড়া রইল সে। গামছায় শরীর মুছল, জামাকাপড় পালটাল। মাথার যন্ত্রণার সঙ্গে চোখ আর নাক দিয়ে অবিরল জল ঝরছে। প্রবল হাঁচি দিল কয়েকটা।
শ্যামশ্রী মুখে কিছু বলছিল না বটে, কিন্তু দরজা খুলবার পর থেকেই একদৃষ্টে লক্ষ করছিল তাকে। ছাড়া জামাকাপড়গুলোর জল নিংড়ে দড়িতে মেলে দিয়ে এল শ্যামশ্রী। নীরবে শুকনো জামাকাপড় সোয়েটার এগিয়ে দিল। রেবন্তর গা আর জামাকাপড় থেকে জল ঝরে মেঝেয় গড়িয়ে যাচ্ছিল, নিজে হাতে চট নিয়ে এসে তা চাপাও দিল শ্যামশ্রী। অস্ফুট স্বরে একবার বলল–ছাদের ঘরে এখন যেয়ো না, ঠাণ্ডা, কিছুক্ষণ এখানেই শুয়ে থাকো লেপ গায়ে দিয়ে।