আমি কি কোনও ভুল করছি? কোনও অন্যায় পথে চলছি? কুঞ্জ গলায় চাপা ব্যাকুলত ফোটে। টর্চের আলোয় দেখা রেবন্তর মুখটায় বড় ঘেন্না ফুটে ছিল যে! ঠোঁট বাঁকান, চোখে আগুন দাঁতে দাঁতে বজ্র আঁটুনি। হিংসে নয়, সংকোচ বা দ্বিধাও নেই। যেন মাজরা-পোকা নিকেশ করতে এসেছিল।
মেজদাদু এবার একটু ব্যস্ত হয়ে বলেন–ভেজা শরীরে এই হিমে কতক্ষণ থাকবে? তোমার শরীর ভাল নয়।
কুঞ্জ সংবিৎ ফিরে পায়। আজ সে কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে তা হঠাৎ টের পেয়ে ভারী লজ্জা করে তার। কোনওদিন কোনও মানুষের কাছে ঠিক এভাবে নিজের সম্পর্কে জানতে চায়নি কুঞ্জ। সে বরাবর নিজের সম্পর্কে গভীর বিশ্বাসী। নিজেকে অভ্রান্ত ভাবাই কুঞ্জর স্বভাব।
সংবিৎ ফিরে পেয়েই কুঞ্জ গুটিয়ে গেল। গম্ভীর মুখখানায় হাসি এল না, তাই না হেসেই বলল যাই মেজদাদু।
–এসো গিয়ে। মাঝে মাঝে এলে ভাল লাগে। বাড়িতে তোমার কেউ যত্ন করে না নাকি তেমন? শুকিয়ে গেছ। তোমার মাকে দেখলে বলব তো।
কুঞ্জ আবার জলঝড়ের মধ্যে বেরিয়ে আসে। বাতাসের মুখে ধেয়ে আসে ধরন বৃষ্টির অস্ত্রশস্ত্র। গেথে ফেলে তাকে বার বার। বৃষ্টির মিছিল চলে তার পিছনে পিছনে, ধিক্কার দেয়–ছিয়া, ছিয়া, ছিয়া…
পিচ রাস্তায় এক নিয়নবাতির তলায় ছোট ভাই রাধানাথের সঙ্গে দেখা। ছাতার নীচে উঁড়ি মেরে যাচ্ছিল। কুঞ্জকে দেখে ভয়ার্ত মুখ তুলে বলল বউদির বড্ড অসুখ, ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি।
-কী অসুখ?
–মেজদা মেরেছে। রক্ত যাচ্ছে খুব।
কুঞ্জ সামান্য কেঁপে ওঠে। হয়তো ভেজা শরীরে হঠাৎ বাতাস লাগল, কিংবা হয়তো অন্য কিছু। ভাবতে চাইল না কুঞ্জ। ভাবতে নেই।
.
খুব অনেক রাতে মেঘ কেটে আকাশে সামান্য জ্যোৎস্না ফুটেছে। বাস থেমেছে। কুগির ঘরখানা নিরিবিলি হয়েছে এতক্ষণে। টুসি জেগে ছিল এতক্ষণ। আর পারল না। এক ধারে মাদুর পেতে তুলোর কম্বল মুড়ি দিয়ে নেতিয়ে পড়েছে অঢেল ঘুমে।
কুঞ্জ একা হল। সাবিত্রীর অবশ্য সাড়া নেই। রক্ত বন্ধ হয়েছে অনেকক্ষণ। কয়েকবারই অজ্ঞান হয়েছে, আবার জ্ঞান ফিরেছে, ফের দাঁতে দাঁত লেগে চোখ উল্টে গোঁ-গোঁ আওয়াজ করেছে। মেঝে ভেসে গিয়েছিল রক্তে। কুঞ্জ তখন ঘরে আসেনি। ভাসুর তো। সব ধোয়া মোছ হওয়ার পর, ভিড় পাতলা হয়ে গেলে এসে একটু দুরে চেয়ার পেতে বসে থেকেছে। এ ঘরে এভাবে বসেখা তার উচিত নয়। খারাপ দেখায়। তবু তার উপায়ও নেই। রাস্তাকি আর মা থাকতে চেয়েছিল, এম জোর করে তাদের শুতে পাঠিয়েছে। কেবল টুসি। ডাক্তার বলে গেছে–ভয় নেই। কিন্তু কুর ভয় অন্য জায়গায়। সে নিঃশব্দে চেয়ে থেকেছে সাড়হীন সাবিত্রীর দিকে। টের পেয়েছে ঠাণ্ডায় বৃষ্টিতে ভিজে তার ডান বুকে জল জমছে। বাঁ বুকে ভয়।
টুসির শ্বাসের শব্দ মন দিয়ে শুনল কুঞ্জ। ঘুমন্ত খাসের শব্দ চিনতে পেরে নিশ্চিন্ত হল একটু। আস্তে নিঃশব্দে উঠে এল বিছানার কাছে। ডাকল না, তবে বিছানার এক পাশে বসল খুব সাবধানে।
অনেক, অনেকক্ষণ বসে রইল। ঘরে একটা মৃদু নীল ঘুমআলোর ডুম জ্বালানো। তাতে আলো হয় না। কেবল দৃশ্যগুলো জলে-ডোবা আবছায়া মতো দেখা যায়। সেই আলোয় যুবতী সাবিত্রীকে বুড়ি বুড়ির মতো দেখায়। দেখতে ভাল লাগে না। অনিচ্ছে হয়। চোখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছে জাগে।
গভীর রাতের এক নিস্তব্ধ মুহূর্তে যখন সাবিত্রীর বিছানায় সসঙ্কোচে বসে অন কুঞ্জ পপুলারিটির কথাই ভাবছিল তখন হঠাৎ খুব বড় করে চোখ মেলল সাবিত্রী। মাঝরাতে হঠাৎ সেই অকানো চোখের দিকে চেয়ে শিউরে ওঠে কুঞ্জ। তারপর মুখ এগিয়ে খুব নরম স্বরে জিজ্ঞেস করে এখন কেমন আছ?
সাবিত্রী জবাব দিল না। বড় বড় চোখে নিষ্প্রাণ প্রতিমা যেমন চেয়ে থাকেঅফেক্ষণ সেইরকম চেয়ে রইল। তারপর খুব ক্ষীণ, নাকিস্বরে বললও কোথায়?
কুঞ্জ গম্ভীর হয়ে বলল-পালিয়েছে।
সাবিত্রী চারদিকে চাইল। টুসিকে দেখল, কুঞ্জর দিকে চেয়ে চোখের ইঙ্গিত করে বলল টুসি।
-ঘুমোচ্ছে।
সাবিত্রী গভীর শ্বাস ছেড়ে বলে–আর সবই?
ধারে কাছে কেউ নেই।
শুনে সাবিত্রী সামান্যক্ষণ চুপ করে থেকে একটু ফুঁপিয়ে উঠে বলে আপনাকেকবার বলেছি ও আমাকে সন্দেহ করে। কিছু টের পেয়েছে।
–আজ কী বলল?
সাবিত্রী কুঞ্জর দিক থেকে অন্যধারে পাশ ফেরে। বলেও জানে।
কুঞ্জ ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায় হঠাৎ। বুক জুড়ে একটা বেলুন ফেঁপে ফুলে উঠে তার দম চেপে ধরে।
কুঞ্জ আস্তে করে বলে–টের পাওয়ার কথা নয়।
সাবিত্রী মুখ ঘুরিয়ে তাকায়। চোখে জল। একটু ক্ষুব্ধ গলায় বলে কী করে জানলেন, টের পাওয়ার কথা নয়? আপনি কি কখনও আমাদের গোপন সম্পর্কের কথা জানতে চেয়েছেন। গত চার মাস ও আমাকে দেয়নি।
বজ্রপাতের মতো আবার সেই পপুলারিটি কথাটা মাথার মধ্যে ফেটে পড়ে কুঞ্জর। তার মন অভ্যাসবশে হিসেব করে নেয়, যদি কেষ্ট সন্দেহ করে থাকে, তবে সেটা চাউর করা তার পক্ষে অসম্ভব নয়। হাব কেপড়ায় মদের মুখে স্যাঙাতদের কাছে বলবে না কি আর? বউ আর দাদাকে জড়িয়ে তামসিক আনন্দ পাবে। যদি কথাটা ছড়ায় তবে কুঞ্জর অনেকখানি চলে যাবে। রেবঙও কি জানে?
বড় ছটফট করে ওঠে কুঞ্জ। বলে–ছোঁয়নি?
সাবিত্রী চেয়েই ছিল। ধীর স্বরে বলল কখনও-সখনও চাইত। আমার ইচ্ছে হত না। ঝগড়া করতুম। তখন রাগ করে গুটিয়ে যেত।