মাসতুতো ভাইদের মধ্যে একজন নলিনী। সে বলল–খুব ভিজেছ কুঞ্জদা, তোমার না বুকের অসুখ! বইয়ের আলমারির ওপর আমার বর্ষাতিটা মেলে দেওয়া আছে, নিয়ে যাও।
কুঞ্জ মাথা নেড়ে বলে-না রে, কিছু হবে না।
নলিনী আর কিছু বলে না। তাস বাটা হতে থাকে। বহুকাল বাদে কুঞ্জর যেন একটু অভিমান হয়। বর্ষাতিটা নিলুম না, তা আর একটু সাধতে পারলি না নলিনী?
কুঞ্জ বেরিয়ে আসে। তার আর একটা ঘাঁটি ছিল ফুটুনিমামার দোকান। জেলেপাড়ার যাট সত্তর ঘর রায়ত ফুটুনিমামার ভারী বশংবদ। একসময়ে পড়াশোনা ছেড়ে রাজনীতিতে নামার দরুন কুঞ্জকে তার বাবা বাড়ি থেকে তাড়িয়েছিল। তখন ফুটুনিমামা কুঞ্জকে আশ্রয় দেয়। বাড়ি গিয়ে বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বলে এসেছিল, আপনি না রাখেন ত্যাজ্যপুত্র করুন, কুঞ্জকে আমি পুষ্যি নেব। নির্বাচনে ফুটুনিমামা তার রায়তদের কুঞ্জর পক্ষে কাজে নামিয়ে দিয়েছিল।
মোড়ের মাথায় ফুটুনিমামার দোকানে ঝাঁপ ঠেলে বহুদিন বাদে কুঞ্জ হানা দিল! মামা উরুর ওপর লম্বা খাতা রেখে হিসেব করছে। খোল, ভুসি, হাঁসমুরগির খাবার আর মশলাপাতির ঝাঁঝালো গন্ধট বহুকাল ভুলে গিয়েছিল কুঞ্জ। আজকাল আসা হয় না। গন্ধটা পেয়ে একটা হারানো বয়স কুঞ্জর কাছে ফিরে এল বুঝি।
মামা মুখ তুলে দেখে বলল কী খবর রে? বলেই ফের হিসেবে ডু দেয়।
কুঞ্জ ঠাণ্ডা হচ্ছে। খুব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। পাথর হয়ে যাচ্ছে। মা আবার মুখ তুলে বলে-দুর্যোগে বেরিয়েছিস, ঠাণ্ডা লাগাবি যে! তারপর খবর-টবর কী?
কুঞ্জ বলে-ভাল।
—ভাল বলছিস? ফুটুনিমামা তাকিয়ে একটু হাসে। কিন্তু তাকানোর মধ্যে দৃষ্টি নেই, হাসির মধ্যে অনেক ভেজাল। একসময়ে খুব বাবুগিরি করত বলে নামই হয়ে গিয়েছিল ফুটুনি। এখন বাবুগিরি নেই। হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে, কাছা খুলে রোজগার করছে মামা। কোথায় যায় মানুষের দিন?
ফুটুনিমামা ভ্রু কুঁচকে বোধ হয় একটা উড়ন্ত মশার দিকে চেয়ে থেকে বলে–তা হলে খবর-টবর সব ভাল?
ঝুরঝুরে মাটির ওপর দিয়ে কুঞ্জ হাঁটছে। যে কোনও একটা পদক্ষেপেই সে দেখতে পাবে সামনেই ধস। তবু কতখানি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার একটা হিসেব নিকেশ থাকা ভাল।
পপুলারিটি শব্দটা রবারের বলের মতো মাথার মধ্যে ধাপাচ্ছে কে!
অন্য দিন সময় হয় না কুঞ্জর। এই দুর্যোগে আজ হঠাৎ সময় হল। বহুদিন বাদে ঝড়বাদল ঠেলে সে মেজদাদুর বাড়ির বারান্দায় উঠে এল। মেজদাদু হলেন এখন ভঞ্জলের সবচেয়ে বড় শরিক! কয়েক কোটি টাকা বোধ হয় তাঁর রোলিং ক্যাপিটাল। দেখে কিছু বোঝা যায় না। সাদাসিধে, গেঁয়ো।
আশির কাছাকাছি বয়স। মস্ত ঘরে কাঠের চেয়ারে বসে আছেন। গায়ে তুষের চাদর, পায়ে মোজা, মাথায় বাঁদুরে টুপি। একদৃষ্টে চেয়ে দেখলেন। বললেন–এত রাতে এলে? খুব দরকার নাকি? কারও কিছু হয়নি তো?
না।
মেজদাদু শ্বাস ছেড়ে বললেন সর্বদাই ভয়ে ভয়ে থাকি। আমি মরলে তোমাদের অশৌচও হয় না জানি। মাতুল বংশ, তায় জ্ঞাতি। কিন্তু আমার ভাবনা তেমনধারা নয়। আমি ভাবি, তেঁতুলতলায় সব আমার মানুষ। কখন কে মরে, কে পড়ে। ভারী দুশ্চিন্তা।
–অনেকদিন দেখা করিনি, তাই এলাম।
কথাটা যেন বিশ্বাস হল না মেজদাদুর। সন্দেহের চোখে কুঞ্জর মুখের দিকে চেয়ে বললেন কারও কোনও বিপদ হয়নি, ঠিক বলছ? ভয়ের কিছু নেই তো!
-না মেজদাদু।
তুমি ভাল আছি তো? বাড়ির সবাই? তোমার মাকে বহুকাল দেখি না। আজকাল সবাইকে দেখতে ইচ্ছে করে।
বলব।
মেজদাদু খানিক চুপ থেকে বলেন-বুদ্ধি পরামর্শ নিতে আমার কাছে কোনওদিন এলে না কুঞ্জ! এলে কি আমি তোমাকে কুপরামর্শ দিতুম! আমি তোমার কতখানি ভাল চেয়েছিলাম তা জানলে না।
কুঞ্জ খুব নিবিড় চোখে মেজদাদুকে দেখছিল। আগে দেখা হলে মেজদাদুর মুখে যে একটা খুশির দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ত তা আজ আর কই? সে বুঝতে পারে, সুর কেটে যাচ্ছে। কোথায় লয়ে-তালে গোলমাল।
কুঞ্জকে জেতানোর জন্য সেবার মেজদাদু নিজের নমিনেশন উইথড্র করে নিয়ে বলেছিলেন লোকে কুঞ্জকেই চায়। আমাদের খামোখা দাঁড়ানো। কথাটা বলেছিলেন হাসিমুখে, আত্মগৌরবের সঙ্গে। সেবার সড়কি খেয়ে কুঞ্জর জখমটা দাঁড়িয়েছিল মারাত্মক। ডাক্তার কলকাতায় পাঠাতে চেয়েছিল। মেজদাদু রুখে দাঁড়িয়ে বললে-কলকাতার হাসপাতাল! কেন, কুঞ্জ কি ভাগাড়ে নড়া। কাতার হাসপাতালে আজকাল মানুষের চিকিৎসা হয় নাকি? ভঞ্জদের লোকবল, অর্থবল সবটুকু ঢেলে দিয়ে মেজদাদু কুঞ্জকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনলেন। আর তার জন্যই তেঁতুলতলার ছোট হাসপাতালে হাজারো যন্ত্রপাতি আমদানি হল, তাল এক ডাক্তার এল চাকরি পেয়ে, এল এক্স-রে ইউনিট! কুঞ্জ যে খুব একটা কৃতজ্ঞ বোধ করছে, তা নয়। সে তখন ভাবত, তাকে বাঁচানোর জন্য লোকে তো এ সব করবেই। সে যে নেতা।
আজ মেজদাদুর সামনে তাই একটু লজ্জা বোধ করে কুঞ্জ। মেজদাদুর জন্য তার যা করা উচিত ছিল তা তো করা হয়নি। অকৃজ্ঞতার পাপ তাকে কিছুটা ছুঁয়ে আছে আজও।
কুঞ্জ মাথা নিচু করে বলে–আপনি আর আগের মতো ডাক খোঁজ করেন না তো দাদু! কোনও অপরাধ করিনি তো?
ভঞ্জবাবু ভারী অবাক হয়ে শশব্যস্তে বললেন–এ সব কী বলছ? অপরাধ আবার কী? বুড়ো বয়সে বাইরের ব্যাপারে বেশি যাই না। তুমিও ব্যস্ত মানুষ। তবে খোঁজখবরে সবই পাই। তোমার হচ্ছে পাবলিক লাইফ, আমরা তো নিজের ধান্দা নিয়ে পড়ে আছি। এই বলে মেজদাদু খানিক কী যেন ভেবে আস্তে করে বলেন–তবে তোমার চেহারায় আগে যেমন একটা তেজ দেখতুম এখন আর সেটা দেখি না।