আজকাল একটা অক্ষম মন নিয়ে চলে রাজু। বর্ষার জলকাদায় খাপুর খুপুর করে যেমন কষ্টে চলতে হয়, রাজুর বেঁচে থাকা এবং কাজ কর্তব্য করাটাও তেমনি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব কাজেই তার ভয়, সব সিদ্ধান্তেই তার নানারকম দ্বিধা।
তবু কষ্টে সে নিজের মনটাকে ঝেড়ে ফেলে উঠে পড়ে। বলে–একটা ছাতা দাও, আর রাধুকে ডেকে দাও।
ধরা গলায় টুসি বলে–আপনি যাবেন?
–যেতেই হবে। নইলে বউটা মরে যাবে যে!
টুসি একটু ভরসা পেয়ে বলে-ঝড়-বাদলায় আপনার যেয়ে দরকার নেই। রাধু ডেকে আনতে পারবে। আপনি শুধু মেজদাকে একটু সামলাবেন। আপনি বড়দার বন্ধু তো, তার ওপর কলকাতার লোক। আপনি সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কিছু বলতে সাহস পাবে না।
রেগে গেলে রাজু সেই পুরনো রাজু। ভয়ডর থাকে না, দ্বিধা থাকে না।
রাজু উঠে দাঁড়িয়ে বলে-আধুকে দৌড়ে যেতে বলল। আমি কেষ্টর ঘরে যাচ্ছি। দড়িতে কুঞ্জর একটা খদ্দরের চাদর ঝুলছিল। সেটা টেনে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে উঠোন পেরিয়ে গিয়ে কেষ্টর দরজায় ধাক্কা মেরে বলল-এই কেষ্ট। দরজাটা খোলো তো।
কেষ্ট দরজা খুলে বেকুবের মতো চেয়ে থাকে। বেশ আঁটসাট গড়নের লম্বাটে চেহারা। ভুরভুর করে কাঁচা দেশি মদের গন্ধ ছাড়ছে। গায়ে এই শীতেও কেবল একটা হাতওলা গেঞ্জি।
রাজু ধমক দিয়ে বলে কী হয়েছে?
অবাক কেষ্ট গলা ঝেড়ে বলে সাবির শরীরটা খারাপ হয়েছে। রক্ত যাচ্ছে।
ওকে এক্ষুনি একটা চড় কষাতে ইচ্ছে করে রাজুর। কিন্তু সেই সঙ্গে ওর মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে পারে, কেষ্ট তাকে দেখে ভয় পেয়েছে। এ ব্যাপারটা বেশ ভাল লাগে রাজুর। তাকে যে কেউ ভয় পাচ্ছে এটা ভেবে তার আত্মবিশ্বাস এসে যায়। গম্ভীর গলায় সে বলে তার জন্য কী ব্যবস্থা করেছ এতক্ষণ? কাউকে ডাকনি কেন?
কেষ্ট সামনের বড় বড় শুকনো দাঁতগুলোয় জিভ বুলিয়ে বলে–কিছু বুঝতে পারছি না। আপনি একবার ভিতরে এসে দেখুন না, খুব সিরিয়াস কেস কি না!
ভিতর থেকে গভীর যন্ত্রণার একটা গোঙানির শব্দ হয় এ সময়ে। রাজুর শরীর কেঁপে ওঠে। একটু আগেই বউটা পান দিয়ে এল ঘরে। আর এখন মরতে চলেছে বুঝি! সে এ সব যন্ত্রণার দৃশ্য সহ্য করতে পারে না আজকাল। রক্তের রং দেখলে তার হাত পা মাথা অবশ হয়ে যায়। সে মাথা নেড়ে বলে, না! তুমি বরং লোকজন ডেকে আনো।
কেষ্টর রগচটা ভাব মরে গিয়ে এখন সত্যিকারের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। মদের নেশা কেটে গেছে একেবারে। বললযাচ্ছি। আপনি একটু দাঁড়ান এখানে, টুসি এক্ষুনি আসবে।
এই বলে কেষ্ট উঠোনে নেমে অন্ধকারে কোথায় তাড়াতাড়ি নিমেষে মিলিয়ে যায়। ওর ভাবসাব রাজুর ভাল লাগল না। তার মনে হল, কেষ্ট এই যে গেল, আর সহজে ফিরবে না। কেষ্টর যাওয়ার ভঙ্গি দেখেই রাজুর ভিতরের রাডার যন্ত্রে ব্যাপারটা ধরতে পারে রাজু। কেষ্ট বোধ হয় ধরেই নিয়েছে যে সাবি বাঁচবে না। থানাপুলিশ হবে। তাই পিটটান দিল।
৫-৮. ছাতার শিক ছটকে উল্টে গেছে
০৫.
হাউর বাতাসে ছাতার শিক ছটকে উল্টে গেছে, হাঁটুভর কাদা আর ঝড় বাদলা ঠেলে শেয়ালের মতো ভিজতে ভিজতে রবিরবাড়ি পৌঁছয় কুঞ্জ। ভেজা শরীরে বাতাস লেগে শীতে মুরগির ছানার মতো কাঁপছে।
ডাকাডাকিতে খোড়ো চালের মেটে ঘর থেকে জানালার ঝাঁপ ঠেলে সতর্ক চোখে কুঞ্জকে আগে দেখে নেয় রবি। দরজা খুলতেই কুঞ্জ দেখল রবির হাতে একটা মস্ত দা। কুঞ্জ জামাকাপড়ের জল যথাসাধ্য নিংড়ে ঘরে ঢুকতেই রবি দড়াম করে দোর দিয়ে বাঠাম লাগাল। কনো মুখে আর চোখের চাউনিতে কুঞ্জকে ভাল করে আর একবার দেখে নিয়ে দাটা কুলুঙ্গিতে খাড়া করে রেখে এসে বলল– ভাবলাম বুঝি তোমার পেটি আর গাদা আলাদা করেছে শালারা।
শীতে সিটিয়ে গেছে কুঞ্জ। দাঁতে দাঁতে ঠকঠক শব্দ। চাদর নিংড়ে মাথা গা মুছতে মুছতে বলে চিনতে পেরেছিস?
রবি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে–টের পেলে খুন করবে। তুমি বলেই বলছি। শালা লাফ দিয়ে সামনে পড়ে আমার চুলের মুঠি ধরে মাথাটা নামিয়ে ফেলল, হাতে অ্যাই বড় গজ। মুখটা কম্ফর্টারে ঢাকা। খুব একটা ঘড়ঘড়ে খাসের শব্দ হচ্ছিল। আমি তো সব সময়ে তোমার পেছু পেছু যাই, তাই মনে হয় আমাকে তুমি ভেবে ভুল করেছিল। গজ যেই তুলেছে, অমনি পিছন থেকে আর এক শালা বলল ওটা কুঞ্জ নয়, রবি। দুটো গাট্টা দিয়ে ছেড়ে দে, খুব পালাবে। তখন ছাড়ল। পেটে দুটো হাটুর গুতো দিয়ে বলল-রা করলে খুন হয়ে যাবি। ছাড়া পেয়ে পোঁ-পোঁ দৌড়ে পালিয়ে এসেছি। পালাতে পালাতেই ঠিক পেলুম, এ হল পটল। পিছনের দুজন কে ঠাহর পাইনি। একজন লম্বা।
কুঞ্জর গা থেকে জল গড়িয়ে ঘরে থকথকে কাদা হয়ে গেল। একদিকে বাঁশের মাচানে চ্যাটাই আর গুচ্ছের ময়লা কাঁথার বিছানা। অন্য ধারে একটা মস্ত ছাগল চটের জামা পরে একরাশ নাদির মধ্যে বসে এই রাতেও কী চিবোচ্ছে। ঘরময় ভরভরে ছাগলের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। কুঞ্জ রবির দিকে স্থির চোখে চেয়ে সবটা শুনে মৃদু স্বরে বলল দেখেছিস দেখেছিস। ক্লাবে কিছু জানাসনি তো!
যখন দৌড়চ্ছি তখন ক্লাবের সামনে একজন জিজ্ঞেস করছিল কী হয়েছে, কেন দৌডুচ্ছি। কিন্তু তখন এত হাঁফ ধরেছে যে মুখে কথা এলই না। তোমাকে কী করল?
কী করবে! কিছু করেনি।
–তুমি মরে ভূত হয়ে আসনি তো কুঞ্জদা!ইস, ভিজে ঢোল হয়েছ। আমার ক্যাঁথা কম্বল গায়ে দিয়ে বোসো। ছাতাটা দাও, সুতো দিয়ে শিকগুলো বেঁধে দিই।